ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’

ইতিহাসের মোড় ঘোরানো চিঠি

ফিলিস্তিনের গাজা থেকে মাত্র দুই মাইল উত্তরে অবস্থিত একটি কিবুৎজ অঞ্চলে ১৯৩০-এর দশকে পোল্যান্ড থেকে আগত ইহুদিরা কৃষিভিত্তিক বসতি স্থাপন করেছিল। পাশেই বাস করতেন শত শত বছর ধরে বসবাসরত ফিলিস্তিনি (Palestinian) আরবরা, যাদেরও ছিল কৃষি খামার। সে সময় মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। তবে ধীরে ধীরে জমি হারানোর বিষয়টি বুঝতে শুরু করেন ফিলিস্তিনিরা, কারণ বিপুল সংখ্যক ইহুদি সেখানে জমি ক্রয় করতে থাকেন।

ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পথে ইতিহাসের বিতর্ক

ইসরায়েল (Israel) রাষ্ট্র গঠনের সময় প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হন, যারা আশাবাদী ছিলেন ভবিষ্যতে ঘরে ফিরতে পারবেন। কিন্তু সেই প্রত্যাবর্তন আর সম্ভব হয়নি। ইসরায়েলের সাবেক প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ (Shimon Peres) এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনিরা আলাদা রাষ্ট্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ‘ভুল’ করেছিল এবং এজন্য ইহুদিরা দায়ী নয়।

বেলফোর ডিক্লারেশন: একটি জাতির ভাগ্য বদলের শুরু

১৮৯৭ সাল থেকেই ইহুদিরা আলাদা রাষ্ট্র চেয়ে আসছিল। ১৯১৭ সালে, যখন ফিলিস্তিন ব্রিটেন (Britain) শাসিত অঞ্চল ছিল, তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর (Lord Arthur James Balfour) ব্যারন রটসচাইল্ড (Baron Rothschild) কে পাঠানো একটি চিঠিতে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য সমর্থন প্রকাশ করেন। ইতিহাসে এই ঘোষণাই “বেলফোর ডিক্লারেশন” নামে পরিচিত, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য বড় বিপর্যয়ের সূচনা করে।

ইউরোপের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ইহুদি আগমন

হিটলার (Hitler) জার্মানিতে ক্ষমতায় আসার পর ইহুদিদের উপর নিপীড়ন শুরু হলে হাজার হাজার ইহুদি ফিলিস্তিনে পাড়ি জমায়। বিষয়টি ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব সংকটে ফেললে তারা ব্রিটিশ সৈন্য ও ইহুদি নাগরিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। কিন্তু এই বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন করে ব্রিটিশ বাহিনী, যা আরব সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে।

বিশ্বযুদ্ধ, অভিবাসন ও জাতিসংঘের প্রস্তাব

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাখো ইহুদি হত্যার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান (Harry Truman) এক লাখ ইহুদিকে দ্রুত ফিলিস্তিনে আশ্রয় দেওয়ার দাবি জানান। কিন্তু ব্রিটেন জানতো এ সিদ্ধান্ত গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করবে। পরবর্তীতে ইহুদি সশস্ত্র দলগুলো ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালাতে শুরু করে এবং ব্রিটেন বাধ্য হয়ে বিষয়টি জাতিসংঘে তোলে।

জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনা ও যুদ্ধের সূচনা

১৯৪৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনে দুটি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেয়, যেখানে ইহুদিদের ১০% জমির মালিকানা থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে ৫০% জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। ফিলিস্তিনিরা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং এরপর শুরু হয় দাঙ্গা।

১৯৪৮: যুদ্ধ ও ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা

১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ সৈন্যরা ফিলিস্তিন ছাড়ে এবং ইহুদি নেতারা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান (Jordan) ও সিরিয়া (Syria)—এই পাঁচটি আরব দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। আরবদের সৈন্য সংখ্যা ৩০ হাজার হলেও সমন্বয়ের অভাব ছিল ব্যাপক।

জেরুজালেম: পবিত্র ভূমির জন্য রক্তক্ষয়

দুই পক্ষই জেরুজালেম (Jerusalem) দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইসরায়েলি বাহিনীর অস্ত্র ফুরিয়ে যায়, তখন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। বিরতির সময় ইসরায়েল চেকোস্লোভাকিয়া থেকে আধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করে ও পুনরায় আক্রমণ শুরু করে।

যুদ্ধের ফলাফল ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব

এই যুদ্ধে ছয় হাজার ইহুদি নিহত হলেও ইসরায়েল স্বাধীনতা অর্জনে সফল হয়। বিশ্লেষকদের মতে, যদি ফিলিস্তিনিরা ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘ প্রস্তাব মেনে নিতো, তবে দুটি রাষ্ট্র শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারতো। তবে পারষ্পরিক অবিশ্বাস, নেতৃত্বহীনতা এবং বৈদেশিক সমর্থনের অভাবে ফিলিস্তিনিরা ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালে হার মানে।