ভয়ংকর চিকিৎসা থেকে সচেতনতার পথে
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান (Sirajdikhan) উপজেলার বালুচর ইউনিয়নের (Baluchar Union) খাসনগর (Khasnagar) গ্রামে একসময় ভয়ংকর ও অমানবিক চিকিৎসার নামে নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত ছিলেন কথিত ভণ্ড পীর আমজাদ হোসেন ব্যাপারী (Amzad Hossain Bepari)। ২০১০ সালের ১২ এপ্রিল প্রথম আলোয় ‘ভণ্ড পীর ভয়ংকর চিকিৎসা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে। সেই প্রতিবেদনে আমজাদের তথাকথিত চিকিৎসা, যা আসলে ছিল নির্যাতন ও অপচিকিৎসা, তা প্রকাশ পায়।
পীরের আসর ও নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র
সর্দি-জ্বর থেকে পক্ষাঘাত পর্যন্ত যে কোনো রোগের জন্য মানুষ ভিড় করত আমজাদের দরবারে। সেখানে ‘ভূত তাড়ানোর’ নামে চলে চরম নির্যাতন—কখনো রোগীকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা, কখনো ঘোরানো, পেটানো, শিশুর পেটে লাফিয়ে ওঠা। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে চলে মারধর ও নাচানোর ভয়াবহ আয়োজন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক রাতে ৭১ জন রোগীকে এমন নির্যাতনের শিকার করা হয়। রোগীদের চিৎকার হারিয়ে যেত ঢোল, খোল আর হারমোনিয়ামের আওয়াজে।
এ সময় সহযোগী মনজিল (Monzil), সুরত আলী (Surat Ali) প্রমুখ টাকা তোলার কাজে লিপ্ত থাকত। চিকিৎসা বাবদ আদায় হতো ১০ থেকে ১০০ টাকা। আরও উল্লেখযোগ্য ছিল, আমজাদ ‘শর্ষের তেল’, ‘ডিম পড়া’, ‘ডাব পড়া’ ইত্যাদিকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতেন।
মামলা, জেল ও পরিণতি
ঘটনার পর ২০১০ সালের ১২ ও ১৩ এপ্রিল অপচিকিৎসা, নির্যাতন ও প্রতারণার অভিযোগে আমজাদসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের হয়। মামলায় আমজাদ ৬ মাস এবং তাঁর সহযোগীদের মধ্যে ৪ জন ৪ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ২০১৩ সালে মামলাগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আমজাদ সবজি বিক্রির কাজ শুরু করেন।
আজকের আমজাদ হোসেন—অসহায় ও শয্যাশায়ী
বর্তমানে আমজাদ হোসেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে স্ট্রোক করার পর তাঁর শরীরের বাঁ পাশ অকেজো হয়ে পড়ে। বসবাস করছেন খাসনগরের একটি জরাজীর্ণ দোচালা ঘরে। সংসারে চলছে চরম অভাব-অনটন। স্ত্রী রাশিদা বেগম (Rashida Begum) ও দুই কন্যা তাঁর সঙ্গী।
আমজাদ বলেন, ‘কবিরাজি কইরা ভুল করছিলাম। এই জন্য মামলা হইছিল, জেল খাটছি। এখন নিজের চিকিৎসা করাইতে পারি না। সংসারে এক বেলা খাইলে আরেক বেলায় খাইতে পারি না।’
কুসংস্কার নয়, চিকিৎসকের শরণাপন্ন মানুষ
খাসনগরের মানুষের চিত্র এখন অনেকটাই বদলে গেছে। গ্রামে শিক্ষার হার বেড়েছে, মানুষ কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন আর কেউ ‘তেল পড়া’, ‘পানি পড়া’ কিংবা ঝাড়ফুঁকের জন্য দরবারে যায় না।
খাসমহল বালুচর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ (Khasmahal Baluchar High School and College)–এর অধ্যক্ষ আলী আশরাফ (Ali Ashraf) বলেন, আগে লতাপাতা বেঁধে চিকিৎসা হতো, এখন মানুষ আধুনিক চিকিৎসার গুরুত্ব বুঝতে শিখেছে।
সিরাজদিখান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (Sirajdikhan Upazila Health and Family Planning Officer) জামসেদ ফরিদী (Jamsed Faridi) বলেন, “মানুষ এখন অসুখ হলে সরাসরি চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে। আগে যারা ভণ্ড পীরদের দ্বারস্থ হতো, তারা এখন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করছে। আমরা বিভিন্ন সেমিনারের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে তুলছি।”
খাসনগরের মানুষ আজ বুঝতে শিখেছে—রোগ হলে চিকিৎসকের কাছেই যেতে হয়, ভণ্ড কবিরাজদের কাছে নয়।