দিনাজপুর (Dinajpur) জেলার বিরল উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামে গত ১৭ এপ্রিল হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা ভবেশ চন্দ্র রায়-এর মৃত্যু নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্ক এখন নতুন মোড় নিয়েছে। প্রথমে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক মহলে একে ‘পিটিয়ে হত্যা’ হিসেবে চিত্রিত করা হলেও স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ এবং ময়নাতদন্তে এর ভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে।
ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রতিবেদন বিভ্রান্তি
ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক প্রাথমিক প্রতিবেদনে ভবেশকে ‘অপহরণ ও পিটিয়ে হত্যা’ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। পরে এই তথ্য ভারতীয় মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায় এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক্সে পোস্ট করে এই ঘটনাকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর ‘পদ্ধতিগত নির্যাতনের’ অংশ হিসেবে অভিহিত করেন।
এমনকি আধ্যাত্মিক গুরু সদগুরুসহ বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী অ্যাকাউন্ট থেকেও ঘটনাটি ঘিরে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।
স্থানীয় প্রশাসনের তদন্ত ও সত্যতা যাচাই
তবে দিনাজপুরের বিরল থানা ও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভবেশের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। পুলিশের ধারণা, তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
বিরল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুস সবুর বলেন, ‘ময়নাতদন্তের আগে কিছুই নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না, তবে পিটিয়ে হত্যার কোনো আলামত মেলেনি।’ একই কথা জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার মারুফাত হোসেন।
ডেইলি স্টারের অবস্থান পরিবর্তন
ডেইলি স্টার পরে বিতর্কিত প্রতিবেদনটি তাদের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেয় এবং স্থানীয় সংবাদদাতা কংকন কর্মকারের সঙ্গে তাদের চুক্তি বাতিল করে। জানা গেছে, স্বাধীনভাবে তথ্য যাচাই না করেই প্রতিবেদন জমা দেওয়ায় এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও বিভ্রান্তির প্রশ্ন
এই ঘটনায় উঠে এসেছে রাজনৈতিক প্রভাব ও উদ্দেশ্যমূলক বয়ানের প্রশ্ন। নিহত ভবেশ চন্দ্র রায় স্থানীয় বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ-এর একজন সহসভাপতি ছিলেন। তার পরিবার আর্থিক সংকটে ছিল এবং স্থানীয় দুই মহাজনের কাছে ঋণ নেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।
পরিবারের দাবি অনুযায়ী, এই মহাজনেরা অর্থ পরিশোধের জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিলেন, যা তার মৃত্যুর পেছনে মানসিক চাপ হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা
বিরল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইশতিয়াক আহমেদ জানান, মরদেহে কোনো দৃশ্যমান আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি এবং ঘটনাটি সাম্প্রদায়িক না হলেও সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে তদন্ত চলছে।
ভারতের প্রতিক্রিয়ার জবাবে বাংলাদেশের অবস্থান
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ভারতের প্রতিক্রিয়ার জবাবে জানান, ‘এই ধরনের ভিত্তিহীন দাবি দুঃখজনক। অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
উপসংহার
যদিও ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু এখনো ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে, তবে পিটিয়ে হত্যার প্রমাণ মেলেনি। এটি নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে প্রচার ও প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল, তা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এখন দেখার বিষয়, ময়নাতদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে কী আসে এবং ঘটনাটি আদৌ কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ছিল কিনা, নাকি প্রকৃতই একটি দুঃখজনক হৃদ্রোগজনিত মৃত্যু।