ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) সরকারের পতনের পর থেকে ভারত (India) ও বাংলাদেশের (Bangladesh) সম্পর্ক ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে। এই টানাপোড়েনের সর্বশেষ পরিণতি—দুই দেশের পারস্পরিক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, যা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় অঙ্গনে জোরালো আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ, সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা
সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ করে দেয়, যার আওতায় বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা ভারতীয় বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য পাঠাতে পারত। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ করে দেয়।
অর্থনীতির ধাক্কা কোথায়?
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য ভারতীয় সুতা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল। সমুদ্র ও আকাশপথে আমদানি এখনো সম্ভব হলেও তা খরচ ও সময় বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমজিএইচ গ্রুপের প্রধান আনিস আহমেদ বলেন, “এটি বাংলাদেশের দ্রুত-ফ্যাশন রপ্তানি খাতের জন্য একটি ধাক্কা।” তাঁর ভাষায়, স্থলপথে ভারত হয়ে পণ্য পাঠাতে সময় লাগত এক সপ্তাহ, যা সমুদ্রপথে হতে পারে আট সপ্তাহ।
বাংলাদেশ গত বছর ৩৮ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে, যার মধ্যে ১ বিলিয়নের বেশি রপ্তানি হয়েছে ভারতীয় পথ ব্যবহার করে।
মুহাম্মদ ইউনূসের মন্তব্য ও উত্তেজনার ব্যাখ্যা
মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বাংলাদেশের “সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক” বলেন এবং ওই অঞ্চলকে “চীনা অর্থনীতির সম্প্রসারণ” হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর নেতারা এই মন্তব্যকে “আক্রমণাত্মক” বলেই ব্যাখ্যা করেছেন।
শিলিগুড়ি করিডোর ও নিরাপত্তা উদ্বেগ
শিলিগুড়ি করিডোর (Siliguri Corridor) ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করে রেখেছে মাত্র ২০ কিলোমিটার প্রশস্ত এক করিডোর দিয়ে। ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, চীনের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে এই করিডোর ভারতের জন্য একটি কৌশলগত দুর্বলতা।
কূটনৈতিক টানাপোড়েন ও নতুন জোটের ইঙ্গিত
বাংলাদেশ ও পাকিস্তান (Pakistan)–এর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, যেখানে গত মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ (Amna Baloch) ঢাকা সফর করেন। একই সময়ে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার (Ishaq Dar)–এর সফর স্থগিত হয়।
ভারতের সাবেক কূটনীতিক শ্যাম শরণ (Shyam Saran) বলেন, “হাসিনাকে আমরা সহজে তুলে দিতে পারি না। দিলে তার কী হবে তা আমরা জানি এবং ভারতীয় জনমতও তা সমর্থন করবে না।”
বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতায় আত্মঘাতী পদক্ষেপের শঙ্কা
ঢাকার দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য (Debapriya Bhattacharya) বলেন, “আগের সরকার ভারতকে যে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছিল, তা পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে।” তার মতে, ভারতও বাংলাদেশের অবকাঠামো ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন করে এবং এ পথে প্রত্যাশিত হারে কার্যক্রম না থাকলেও সুবিধাটি অপরিহার্য।
জনমনে প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
দুই দেশের সাধারণ মানুষ এবং ব্যবসায়ী মহলে এই উত্তেজনার প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট। ভিসা ইস্যুতে ভারতের কঠোরতা বাংলাদেশে অসন্তোষ তৈরি করেছে। অন্যদিকে ভারতীয় মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহল বাংলাদেশকে ‘ইসলামপন্থী হুমকি’ হিসেবে উপস্থাপন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ উত্তেজনা যদি কৌশলগত বিবেচনায় আরও বাড়ে, তবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক হুমকির মুখে পড়বে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হতে পারে।