‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’—গানের ভাষাতেই যেন বাস্তব হয়ে দেখা দিলো মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (Hazrat Shahjalal International Airport) থেকে গুলশান (Gulshan) ফিরোজা ভবন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া উৎসবমুখর পরিবেশে। চার মাস চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন বেগম খালেদা জিয়া (Begum Khaleda Zia)। তাকে স্বাগত জানাতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে এসেছেন হাজারো বিএনপি (BNP) নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ।
নেত্রীকে দেখতে ঢাকামুখী মানুষের ঢল
সকাল থেকেই রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভার এলাকাসহ ভিআইপি রোডের দুই পাশে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কেউ ব্যানার, কেউ দলীয় পতাকা, কেউবা স্লোগানসংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গাড়িবহর যাত্রা শুরু করে বেলা সোয়া ১১টার দিকে। এসময় কুড়িল এলাকায় স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে পরিবেশ। ব্যতিক্রমভাবে এদিন গাড়ির সামনের সিটেই বসেছিলেন বেগম জিয়া।
আবেগঘন পরিবেশে নেত্রীর প্রত্যাবর্তন
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে আসা ৩৭ বছর বয়সী হাফিজ আহমেদ বলেন, “২০ বছর ধরে বিএনপির সঙ্গে জড়িত। মামলা, হামলা, জেল সবই সহ্য করেছি। আজ খোলা আকাশের নিচে মুক্তভাবে স্লোগান দিতে পারছি—এই অনুভূতি ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়।”
কেরানীগঞ্জ থেকে আসা আসলাম শেখ বলেন, “হাসিনা সরকারের সময় কখনও স্লোগান দিতে পারিনি। আজ এই জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে সেই আক্ষেপ দূর করছি।”
রাজধানীর বাড্ডা থেকে আগত যুবদল কর্মী জুলহাস উদ্দিন বলেন, “আমাদের নেত্রী বীর যোদ্ধা। এত ষড়যন্ত্রের পরও তিনি হেরে যাননি। বরং মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিজয়ের মুকুট পরেছেন।”
যানজট যেন উৎসবের অংশ
যদিও সাময়িক যানজট ছিল, কিন্তু তা যেন জনতার উল্লাসে মিলিয়ে যায়। দলের পক্ষ থেকে আগেই নির্দেশনা ছিল ফুটপাতে অবস্থান নিতে। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (Mirza Fakhrul Islam Alamgir) এই নির্দেশনা নিশ্চিত করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো।
একজন বাবা জানালেন, “আমার ছেলেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছবি দেখিয়ে চিনিয়েছি। আজ তাকে সামনে থেকে দেখানোর সুযোগ হয়েছে, এজন্যই এসেছি।”
তুরাগ বাসের চালক মফিজ বলেন, “যানজটতো প্রতিদিনই হয়। আজ নেত্রীকে দেখার সুযোগ মিলেছে—এটাই আনন্দ।”
চিকিৎসার জন্য লন্ডনে, ফিরলেন সুস্থ হয়ে
গত ৭ জানুয়ারি লন্ডনে যান খালেদা জিয়া। কাতারের আমিরের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশে ফিরেছেন তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন পুত্রবধূ জোবাইদা রহমান (Zubaida Rahman) ও সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথি (Syeda Sharmila Rahman Sithi)।
৭৯ বছর বয়সী এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস এবং আর্থ্রাইটিসে ভুগছিলেন। লন্ডনের ‘লন্ডন ক্লিনিক’-এ ১৭ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি, অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধানে। ২৫ জানুয়ারি থেকে বড় ছেলে তারেক রহমান (Tarique Rahman) এর বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন তিনি।
দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও প্রতীকী প্রত্যাবর্তন
এক-এগারোর সময় দায়ের হওয়া মামলায় ২০১৮ সালে দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যান খালেদা জিয়া। ২০২১ সালে করোনা পরিস্থিতিতে সরকার নির্বাহী আদেশে তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়। তবে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। অবশেষে ২০২৪ সালে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন (Mohammad Shahabuddin) এর ঘোষণার মাধ্যমে সাজা বাতিল হয় এবং উচ্চ আদালতের রায়ে খালাস পান। এরপরই উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান তিনি।
তার প্রত্যাবর্তন অনেকের চোখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন বার্তা—এ যেন প্রতিরোধের বিজয়, রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রতীক।