ভূমিকম্প সব থেকে ভয়ানক একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ।আর এটি এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা মানুষকে কোনো ভাবেই হতে দেয় না সতর্ক। সম্প্রতি এমনটাই দেখেছে সারা বিশ্ব। ভূমিকম্প ৭.৫, ৭.৮ — এই ছোট সংখ্যাগুলি, যখন রিখটার স্কেলে পরিমাপ করা হয়,যা বেশ ভয়ঙ্কর!রিখটার স্কেল হল ভূমিকম্পের তীব্রতার একটি পরিমাপ, যা ১০-ভিত্তিক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে গণনা করা হয়।
অর্থাৎ, ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প একই স্কেলের ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের চেয়ে ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী! রিখটার স্কেলের এই ইউনিটগুলি ভূমিকম্পের ধরন নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে ৮ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে তাকে আমরা ‘গ্রেট ভূমিকম্প’ বলি। এই মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ! রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পগুলিকে ‘বড় ভূমিকম্প’ বলা হয়। এই মাত্রার একটি ভূমিকম্পও তার সাথে মারাত্মক ক্ষতি নিয়ে আসে। সাম্প্রতিক তুরস্ক-সিরিয়া ভূমিকম্পের তীব্রতা এর উজ্জ্বল উদাহরণ।
তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পে বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। চোখের পলকে হারিয়ে গেছে দেড় হাজার তাজা প্রাণ। ১০০,০০০ এর বেশি আহত হয়েছে। অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বলাই বাহুল্য, স্মৃতিতে এই ভয়াবহ দুর্যোগে অঞ্চলগুলো অবর্ণনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, যখন বড় প্লেট এবং সাবপ্লেটের সংযোগস্থলে দীর্ঘ সময় ধরে শক্তি জমা হয়, তখন সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়। তবে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব।
প্রায় ১০০ কিলোমিটার ফল্ট লাইন বরাবর আঘাত করা এই ভূমিকম্প সম্পর্কে বলতে গিয়ে পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আগ্নেয়গিরি ও ঝুঁকি যোগাযোগ বিভাগের রিডার ড. কারমেন সোলানা বলেন, তুরস্কে প্রায় দুইশ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি।
ফলস্বরূপ, অঞ্চলগুলিতে ভূমিকম্প-সম্পর্কিত প্রস্তুতি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যার কারণে মূলত ক্ষয়ক্ষতি বেড়েছে বহুগুণ। তিনি আরও বলেন, দুর্ভাগ্যবশত তুরস্ক ও সিরিয়ার অবকাঠামো খুব একটা ভূমিকম্প প্রতিরোধী নয়। বিবিসির এক প্রতিবেদনে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত তুরস্কে বেশ কয়েকটি ভবন নির্মাণে ‘অযত্ন-অবহেলার’ চিত্র উঠে এসেছে। দেখা যায়, নিহতদের বেশিরভাগই ওই ভবনগুলোতে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ভূমিকম্প যতই তীব্র হোক না কেন, সতর্ক প্রস্তুতি থাকলে তুরস্কের এত বড় ক্ষতি হতো না। কারণ এটি সর্বজনবিদিত যে কীভাবে সঠিক বিল্ডিং প্রবিধানগুলি সমস্ত তীব্র ভূমিকম্প সত্ত্বেও জাপানের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশেও বিপর্যয় এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে মানুষকে রক্ষা করে।
তুরস্কে ভূমিকম্পের পর বিশ্বের কোনো কোনো স্থানে ভূমিকম্পের খবর শোনা গেছে। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে ৪.৩ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্প মৃদু হলেও বাংলাদেশের জন্য একটি আশ্রয়স্থল। গত দুই দশক ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণা করছে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণায় দেখা যায় যে বাংলাদেশ যে প্লেটের উপর অবস্থিত, অর্থাৎ ভারতীয় প্লেট এবং বার্মিজ সাবপ্লেটের সংযোগস্থল, সেখানে ৪০০ থেকে এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে শক্তি জমা হয়েছে।
যে কোনো সময় বাংলাদেশে ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ভারতীয় প্লেট প্রতি বছর ৬ সেমি হারে এবং বার্মিজ সাবপ্লেট প্রতি বছর ২ সেমি হারে নড়ছে। ফলস্বরূপ ভারতীয় প্লেট অধঃপতিত হচ্ছে এবং বার্মিজ সাবপ্লেট পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছে। বুয়েটের একদল গবেষক বলেছেন, বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্র দেখায় যে প্রায় ৪৩ শতাংশ এলাকা ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
কি ভয়ানক উদ্বেগ! বাংলাদেশের দুটি সক্রিয় উত্স থেকে ভূমিকম্প, সিলেটের ডাউকি ফল্ট এবং পূর্বে ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোন, সবচেয়ে মারাত্মক হবে! সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশের সবচেয়ে জনবহুল শহর, ঢাকা, এই নদী থেকে ৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
আর দুর্ভাগ্যবশত বিল্ডিং রেগুলেশন অ্যাক্ট লঙ্ঘনের চিত্রও বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এ অবস্থায় হাজার বছরের সঞ্চিত শক্তি ফেটে গেলে বাংলাদেশের অবস্থা যে তুরস্কের চেয়েও খারাপ হবে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যতবাণী, ‘দিন অতি নিকটে’! সুতরাং, আমাদের ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে—আমরা কি পূর্ব প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সতর্ক হব, নাকি তুরস্কের মতো ভয়াবহ দুর্যোগকে স্বাগত জানাব!
প্রসঙ্গত, এ দিকে বাংলাদেশকে বার বার সতর্ক করছে বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছে বাংলাদেশে ভূমিকম্প হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। আর এই কারণে অবশ্যই আগে থেকে যদি আগাম প্রস্তুতি নিয়ে না রাখা হয় তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বাংলাদেশে। তাই এটা নিয়ে এখন ভাবার মোক্ষম সময়।