পারিবারিক কলহের পাশাপাশি স্বামীর সঙ্গে ছোট বোনের অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠায় বেশ ক্ষিপ্ত ছিলেন মেহজাবিন ইসলাম মুন। অনেক চেষ্টার পরও বিষয়টির কোনো সমাধান না হওয়ার একপর্যায়ে বাবা-মা ও বোনকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন মেহজাবিন। আর এরই ধারাবাহিকতায় ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সবাইকেই হত্যার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে।
গত ২ বছর আগে রাজধানীর কদমাতলী এলাকায় বাবা, মা ও বোনকে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার হন মেহজাবিন।
মুনের বিরুদ্ধে তার পরিবারকে সমর্থন করতে এবং তার স্বামীকে কাছে পাওয়ার জন্য তার বাবা-মা এবং বোনকে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি মামলার তদন্ত শেষে কদমাতলী থানার পরিদর্শক (নিরস্ত্র) ফেরদৌস আলম সরকার মুনকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করেন।
চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে, স্বামীকে পাওয়ার জন্য মেহজাবিন তার বাবা-মা ও বোনকে হত্যা করেছে।
২০২১ সালের ১৮ জুন রাতে রাজধানীর কদমতলী এলাকায় চা-কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে বাবা মাসুদ রানা, মা মৌসুমী ইসলাম ও বোন জান্নাতুল ইসলাম মোহিনীকে হত্যা করে মেহজাবিন ইসলাম মুন। এ ঘটনায় মাসুদ রানার বড় ভাই সাখাওয়াত হোসেন মেহজাবিন ও শফিকুল বাদী হয়ে কদমাতলী থানায় হত্যা মামলা করেন। মেহজাবীন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এ মামলায় তার স্বামী শফিকুল জামিনে থাকলেও অন্য মামলায় কারাগারে রয়েছেন।
মামলার বাদী সাখাওয়াত হোসেন পুলিশের অভিযোগপত্রের বিষয়ে বলেন, একটি মেয়ের পক্ষে ৩ জনকে হত্যা করা সম্ভব নয়। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি ঘটনার সঙ্গে শফিকুল জড়িত। শফিকুলের আগে থেকেই সম্পত্তি ভোগ করার মানসিকতা ছিল। শফিকুল মুনকে হত্যায় প্ররোচিত করে। ঘটনার সময় শফিকুল বাসায় ছিলেন। পুলিশ চার্জশিটে মুনকে আসামি করে শফিকুলকে খালাস দেয়। এই তদন্ত প্রতিবেদন আমরা মানি না। আমরা চাই ঘটনার আসল রহস্য উদঘাটন হোক, প্রকৃত অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।
এদিকে বাদী সাখাওয়াত হোসেন বাদী হয়ে পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রে গত বছরের ৬ অক্টোবর অভিযোগ দায়ের করেন। মামলার বাদী মামলার তদন্ত সঠিকভাবে হয়নি বলে উল্লেখ করেন। চাঁদ একা এত বড় ঘটনা ঘটাতে পারে না। অন্যরা জড়িত। আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মহানগর হাকিম আরফাতুল রাকিবের আদালত মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে।
মামলার চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শফিকুলের সঙ্গে মেহজাবিনের বিয়ে হয়। তাদের একটি মেয়ে রয়েছে। মাসুদ রানা ২৬ বছর ধরে সৌদি প্রবাসী ছিলেন। তার স্ত্রী মৌসুমী ইসলাম ও মেয়ে জান্নাতুল ইসলাম মোহিনী কদমতলী থানার মুরাদপুরে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। মাসুদ রানা ভাড়া বাসায় এসে থাকতেন।
স্বামী-সন্তানসহ মেহজাবীন কদমতলী পূর্ব জুরাইন এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। মাসুদ রানা মাঝে মাঝে সৌদি আরব থেকে তার স্ত্রী মৌসুমীর কাছে মূল্যবান জিনিসপত্র পাঠাতেন। মোহিনীকে লেখাপড়া শিখিয়ে ভালো মানুষের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য মৌসুমী ধন-সম্পদ সঞ্চয় করতে থাকে। তার মা মেহজাবীনকে তার বাবার পাঠানো কিছুই দেয়নি। এতে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
অপরদিকে শফিকুল তার স্ত্রীর ছোট বোন মোহিনীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ বিষয়ে মেহজাবীন তার বোনকে বারবার সতর্ক করলেও সে শোনেনি। মেহজাবীন তার বাবা-মাকেও জানায়। কিন্তু তারা কোনো কথাই বলে না। আগের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের তিন মাস আগে, হত্যা করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। মেহজাবিন প্রথমবার ব্যর্থ হয়ে পুনরায় তাদের হত্যার পরিকল্পনা শুরু করে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, একই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১০ জুন রাত ৮টার সময় মুরাদপুরের একটি ফার্মেসি থেকে ৯টি, ১৫ জুন আরও দু’টি এবং ১৬ জুন ১০টি ঘুমের ওষুধ কেনে। আর ১৭ জুন শনিরআখড়া ফুটপাতের দোকান থেকে একটি চাপাতি ও কাঁচি কেনেন। ১৮ জুন রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঘুমের ট্যাবলেট, চাপাতি, কাঁচি, স্বামী-সন্তানসহ বাবার বাসায় যায়। পূর্বের ভুল-ত্রুটির বিষয়ে ক্ষমা চায়। তারা তাকে ক্ষমা করে বাসায় থাকতে বলেন।
খাওয়া-দাওয়া শেষে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত ১১টার দিকে মেহজাবিন চা-কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে সবাইকে খেতে দেয়। তারা সবাই অজ্ঞান হয়ে গেলে ঘরের প্রধান দরজা বন্ধ করে, বারান্দায় কাপড় শুকানোর দড়ি কেটে মায়ের পিঠে জড়িয়ে হাত-পা বেঁধে রাখে। বাবা ও বোনকে ওড়না দিয়ে মুড়িয়ে হাত-পা বাঁধা। ওড়না পেঁচিয়ে তিনজনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। মোহিনী টের পেয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করলে মেহজাবিন তার মুখে দুটি পলিথিন ঢুকিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে যা বলেছেন মেহজাবীনও।
জানা গেছে, কদমতলীর মুরাদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে লালমিয়া সরকার সড়কের ২৮ নম্বর ছয়তলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন মাসুদ রানা। তার সঙ্গে থাকতেন স্ত্রী মৌসুমী ও ছোট মেয়ে জান্নাতুল। দীর্ঘ ২৬ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে ২০২১ সালে দেশে ফেরেন মাসুদ রানা। ২০১৪ সালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে তাদের বড় মেয়ে মুনের প্রথম বিয়ে হয়। বিয়ের ছয় মাস পর খুন হন স্বামী আমিন।
এ ঘটনায় এখনো তদন্তের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ হত্যার কাণ্ডের সঙ্গে অন্য আর কেউ জড়িত রয়েছে কিনা, সে বিষয়টিকেও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানা গেছে।