হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে গুলতেকিন খানের বেদনাময় স্মৃতিচারণ

বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ (Humayun Ahmed)–এর সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন খান (Gultekin Khan) ফের শেয়ার করলেন এক হৃদয়বিদারক স্মৃতি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি ব্যক্ত করেছেন এক সন্তান হারানোর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা ও সেই সময়কার পারিবারিক টানাপড়েন। স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে আমেরিকায় ভ্রমণ, পড়ালেখা, গর্ভকালীন কষ্ট, সন্তান জন্ম এবং সন্তান হারানোর যন্ত্রণার গল্প—যা একাধারে এক মা, এক শিক্ষার্থী ও এক জীবনসংগ্রামী নারীর কাহিনি।

পড়ালেখা, সংসার ও বিদেশযাত্রা

গুলতেকিন জানান, বিয়ের পর তিনি হলিক্রস কলেজ (Holy Cross College)–এ ভর্তি হন এবং প্রথম সন্তানের জন্মের আগেই আমেরিকায় যেতে হয় তাঁকে। সেই যাত্রার আগে হুমায়ূনের একটি লেখা চিঠির কথা উল্লেখ করেন, যা “হোটেল গ্রেভার ইন” বইয়ে বর্ণনা করা হয়েছে, তবে বাস্তবতা ছিল আলাদা।

দেশে ফিরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় কন্যার জন্ম হয়। এরপর তিনি নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (University of Dhaka)–এ ভর্তি হন। গর্ভাবস্থার কষ্টের মাঝেও সন্তানদের যত্ন, রান্নাবান্না, নাটকের শুটিংয়ে অংশগ্রহণ ও স্বামীর কাজের সহযোগিতা—সব কিছু সামাল দিতে হয় তাঁকে।

প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও একাকিত্ব

গুলতেকিনের অভিযোগ, হুমায়ূন আহমেদ পড়ালেখার সময় তাঁর সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর লেখালেখির ব্যস্ততায় সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। তিনি লেখেন, নাটকের কাজ বিলম্বিত করার অনুরোধ করলেও হুমায়ূন রাজি হননি।

এছাড়া গর্ভকালীন জটিলতায় ভোগা অবস্থায়ও ক্লাস করতেন গুলতেকিন। টিস্যু না থাকায় পুরনো কাগজে থুথু জমিয়ে রাখতে হতো তাঁকে।

সন্তানের জন্ম ও চরম বেদনা

হুমায়ূনের আমেরিকায় যাওয়ার আগে সন্তানের জন্ম দেন গুলতেকিন। নির্ধারিত সময়ের ৫ মিনিট দেরিতে ক্লিনিকে পৌঁছানোর কারণে চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকেন এবং অবশেষে রাতে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম নেয়।

কিন্তু সন্তান জন্মের পর দেখা দেয় Meconium Aspiration Syndrome নামক জটিলতা। চিকিৎসক জানিয়ে দেন, শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক। তিন দিনের মাথায় শিশুটি মৃত্যুবরণ করে। গুলতেকিন স্মরণ করেন, তাঁর কোলে রাখা হয়েছিল সাদা তোয়ালে—যা ছিল সন্তান হারানোর নিঃশব্দ প্রতীক।

পরীক্ষা, সংগ্রাম ও মায়ের প্রত্যয়

সন্তান হারানোর মাত্র কয়েক দিন পরই ছিল তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হলেও গুলতেকিন পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বন্ধু রিংকুর সহায়তায় পরীক্ষার হলে প্রবেশ করেন। সারা পরীক্ষাজুড়ে চোখ থেকে অশ্রু ঝরলেও, তিনি প্রশ্নের উত্তর লেখেন। সিঁড়ি বেয়ে কাঁদতে কাঁদতে নামার মধ্য দিয়ে তাঁর আত্মবিশ্বাসী বার্তা—“আমার সন্তানরা যেনো দেখে শেখে, জীবনে যত ঝড় আসুক, পড়াশোনা শেষ করতেই হবে।”

এই আত্মকথনে গুলতেকিন খান শুধু একজন মাতৃহৃদয় নারীর নয়, বরং এক সংগ্রামী নারীর জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। পারিবারিক জীবনের ওঠাপড়া, সামাজিক চাপ এবং ব্যক্তিগত কষ্টের মাঝেও এগিয়ে যাওয়ার গল্প এটি।