বাংলাদেশে ড. ইউনূস প্রশাসনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত: আল-জাজিরার বিশ্লেষণ

আল-জাজিরা (Al Jazeera) এক বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus)-এর প্রশাসন বর্তমানে গভীর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনের মুখোমুখি। রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ, সামরিক-বেসামরিক দ্বন্দ্ব এবং নির্বাচনী প্রশ্নে মতপার্থক্যের কারণে সরকারের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

সামরিক-বেসামরিক দ্বন্দ্ব ও ‘ঠাণ্ডা লড়াই’

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকারে সামরিক ও বেসামরিক অংশের মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। গত ২০ মে সেনাবাহিনী (Military)-র শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক ‘দরজার আড়ালের বৈঠক’ এই উত্তেজনার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছে আল-জাজিরা। ঢাকায় এই দ্বন্দ্বকে অনেকেই ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ হিসেবেও ব্যাখ্যা করছেন।

সেনাপ্রধানের বক্তব্য ও সেনাবাহিনীর অবস্থান

২১ মে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান (General Waqar Uz-Zaman) বলেন, “সেনাবাহিনী পুলিশ নয়—নির্বাচনের পর ব্যারাকে ফিরতে হবে।” তিনি স্পষ্ট করে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি বেসামরিক দায়িত্ব সেনাবাহিনীর জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ হতে পারে।

তার আরও বক্তব্য ছিল:

  • অস্থায়ী সরকার যেন দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত না নেয়;
  • রোহিঙ্গা ইস্যুতে রাখাইনে মানবিক করিডোর পরিকল্পনায় আপত্তি;
  • চট্টগ্রাম বন্দর (Chittagong Port) পরিচালনায় বিদেশি হস্তক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ;
  • স্টারলিংক প্রকল্প ও জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি;
  • সরকার সেনাপ্রধানকে সরাতে চেয়েছিল—এমন গুজবও প্রচলিত।

রাজনৈতিক চাপ ও বিভাজন

২০২৪ সালের ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ক্রমেই রাজনৈতিক দলগুলোর চাপের মধ্যে পড়েছে। বিএনপি (BNP) ডিসেম্বর ২০২৫-এ নির্বাচন চায়, যেখানে জামায়াতে ইসলামি (Jamaat-e-Islami) ও ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) (National Citizen Party – NCP) সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিতে চায়।

বিএনপি আরও দাবি করেছে:

  • ২০২০ সালের ‘জালিয়াতিপূর্ণ’ মেয়র নির্বাচন বাতিল করে তাদের প্রার্থীকে পুনর্বহাল করতে হবে;
  • দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ।

এই দাবিগুলো শনিবার (২৪ মে) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা (State Guest House Jamuna)-তে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে তোলা হয়।

ইউনূসের পদত্যাগ গুঞ্জন ও অভ্যন্তরীণ হতাশা

২২ মে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ড. ইউনূস নাকি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করছে না, আমি কার্যক্রম চালাতে পারছি না। সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না হলে আমি তার দায় নিতে পারব না।”

এ সময় এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম (Nahid Islam) তাকে অনুরোধ করেন পদত্যাগ না করতে। ড. ইউনূস উত্তরে বলেন, “আমি যেন জিম্মি হয়ে পড়েছি।”

সংস্কারপ্রস্তাব ও প্রশাসনিক প্রতিরোধ

বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমও আটকে আছে:

  • জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) (NBR)-কে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও, সিনিয়র কর্মকর্তারা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন;
  • প্রশাসনের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য বিশ্লেষকদের।

বিএনপির অবস্থান

বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (Amir Khasru Mahmud Chowdhury) বলেন, “আমরা ড. ইউনূসের পদত্যাগ চাই না, আমরা চাই তিনি নির্বাচন দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন।”

বিভিন্ন দলের ভিন্নমত

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (Islami Andolon Bangladesh) এবং জামায়াতে ইসলামি বলছে, আগে জাতীয় ঐক্য গঠন এবং নতুন সংবিধানের রূপরেখা তৈরি করতে হবে।

জামায়াতের দাবি:

  • নির্বাচন নয়, আগে প্রতিরোধ আইন;
  • প্রোপোরশনাল ভোটিং ব্যবস্থা;
  • গণপরিষদ নির্বাচন।

কী হতে পারে সামনে?

রাজনৈতিক বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনি (Rezaul Karim Rony) বলেন, “ড. ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে আলোচনা সরকারের ভেতরের মতবিরোধ এবং সংহতির ঘাটতির ইঙ্গিত।”

তিনি আরও বলেন, “নির্বাচনের আহ্বান দিলে সেটি বিএনপিপন্থি মনোভাব হিসেবে দেখা হতে পারে। তবে সিদ্ধান্ত জনগণের হাতে।”

নাহিদ ইসলাম এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘আবার ১/১১-এর ষড়যন্ত্র চলছে।’ তার আহ্বান:

  • জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা;
  • ডিসেম্বর থেকে জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন;
  • জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার;
  • সংবিধান সংস্কারের রূপরেখা এবং গণপরিষদ নির্বাচন।

উপসংহার

অন্তর্বর্তী সরকারের ভবিষ্যৎ এখন রাজনৈতিক চাপ ও সেনাবাহিনীর অবস্থানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার ওপর নির্ভর করছে। গণতান্ত্রিক উত্তরণের যে স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল, তা এখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে—এই পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস কতটা দৃঢ়ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন?