মেট্রোরেল (Metro Rail)-এর দুই লাখ ৪০ হাজার একক পাসের গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনায় যাত্রী ভোগান্তির পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা ও জবাবদিহির অভাব প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (Dhaka Mass Transit Company Limited)–ডিএমটিসিএল এবং ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (Dhaka Transport Coordination Authority)–ডিটিসিএর মধ্যকার সমন্বয়হীনতাও সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
কীভাবে হারিয়ে গেল এত পাস?
২০২২ সালে মেট্রোরেল চালুর সময় ডিএমটিসিএল ৩ লাখ ২০ হাজার একক পাস সংগ্রহ করলেও পরে দাবি করা হয়, যাত্রীরা দুই লাখ ৪০ হাজার পাস নিয়ে গেছেন। এই বিপুলসংখ্যক পাস হারিয়ে যাওয়া নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত হয়নি। বরং ডিএমটিসিএলের লাইন-৬ প্রকল্প পরিচালক মো. জাকারিয়া জানান, “অনেকে দুটি পাস নিয়েছে, কিছু ফেরত দেয়নি। এটা সব দেশেই হয়।”
যাত্রীরা বলছেন, একক পাসের অভাবে প্রতিদিন দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। অনেক সময় পাস না পেয়ে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। ফলে মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশনেই যাত্রীদের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে।
চাহিদা বাড়লেও সরবরাহে ঘাটতি
বর্তমানে মেট্রোরেলের দৈনিক যাত্রী সংখ্যা প্রায় চার লাখ। তাদের মধ্যে প্রায় দুই লাখ নিয়মিত যাত্রী একক পাস ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু পাস হারিয়ে যাওয়ায় বর্তমানে মাত্র ৬০ হাজার একক পাস রয়েছে। সম্প্রতি ১ লাখ ২০ হাজার নতুন পাস কেনা হলেও এখনও তা সক্রিয় হয়নি। ফলে পাসের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ লাখ ৮০ হাজার, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
তদন্ত ও জবাবদিহির ঘাটতি
ডিএমটিসিএল জানায়, তারা পাসের হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কোনো তদন্ত করেনি এবং এই সংকটের পেছনে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাও স্পষ্ট করে বলা হয়নি। অন্যদিকে ডিটিসিএ বলছে, তারা চাহিদা অনুযায়ী যথাসময়ে পাস পায়নি। এমনকি অতিরিক্ত চাহিদা মোকাবিলায় নতুন পাস যুক্ত করার প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হয়েছে।
বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও দায় এড়ানোর প্রবণতা
সাবেক এমডি এম এ এন সিদ্দিক (M A N Siddique)-এর বিরুদ্ধে রয়েছে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ওবায়দুল কাদের (Obaidul Quader)-এর আশীর্বাদে র্যাপিড পাসের বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে এমআরটি পাস চালু করেন। ফলে র্যাপিড পাস স্টেশন থেকে সরবরাহে বাধা দেওয়া হয় এবং ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বুথ থেকেও বিতরণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়।
পাস সরবরাহকারী এজেন্টদের স্টেশন থেকে বের করে দেওয়া
ডিটিসিএর নিয়োগকৃত রিচার্জ এজেন্টদের মেট্রো স্টেশনে বসতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। স্টেশন কন্ট্রোলাররা লিখিত অনুমতির শর্তে বসার অনুমতি দিচ্ছেন, তাও সুনির্দিষ্ট নিয়মে। এতে যাত্রীসেবার গতি ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকার পরিবর্তনের পর প্রশাসনিক অচলাবস্থা
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ডিএমটিসিএলের তৎকালীন এমডি সিদ্দিককে অপসারণ করে আব্দুর রউফ (Abdur Rouf)-কে ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়। পরে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন এমডি হিসেবে ফারুক আহমেদ (Faruk Ahmed)-কে দায়িত্ব দেওয়া হলেও ডিএমটিসিএলে সিদ্দিকের প্রভাব এখনো বিদ্যমান।
যাত্রীসেবার জন্য প্রয়োজনীয় পাস ও সেবার সহজলভ্যতা না থাকায় যাত্রীরা যেমন ক্ষুব্ধ, তেমনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায় এড়ানোর প্রবণতা এবং জবাবদিহির অভাব জনগণের আস্থা হারাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।