বাংলাদেশ (Bangladesh)–এর সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court) ২০২৫ সালের ২৭ মে একটি যুগান্তকারী রায় দিয়ে দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের ধারা নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে। এই রায়ের ফলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর (Bangladesh Jamaat-e-Islami) সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম (ATM Azharul Islam)–এর মৃত্যুদণ্ড বাতিল করা হয় এবং পরদিন, ২৮ মে, ১৩ বছর কারাভোগের পর তিনি মুক্তি পান। এই সময়ের মধ্যে প্রায় ১১ বছর তিনি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায় ফাঁসির কক্ষে ছিলেন।
ইতিহাসে প্রথম
এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধ মামলায় আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে। এই রায় শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির রায় নয়; বরং এটি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়াকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে এবং পূর্ববর্তী রায়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
আদালতের অনুশোচনা ও ত্রুটির স্বীকার
সংক্ষিপ্ত আদেশে, আপিল বিভাগ পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ (Awami League) সরকারের আমলে সংঘটিত বিচারিক ত্রুটির জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করে। এতে আদালত নিজ প্রতিষ্ঠানের ভুল স্বীকার করে নেয়, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বেশ কয়েকটি কার্যকর হওয়া মৃত্যুদণ্ডের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তোলে।
পটভূমি ও রায়ের বিবরণ
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সেই রায় বহাল রাখে। পরবর্তীতে ২০২০ সালে তিনি রিভিউ আবেদন করেন। সেই সময় অনেকেই ধারণা করেছিলেন আবেদনটি বাতিল হলে দ্রুত ফাঁসি কার্যকর হবে।
রাজনৈতিক পালাবদল ও বিচারব্যবস্থায় পরিবর্তন
২০২৪ সালের জুলাইয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা হারালে বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের ফলে আজহারুল ইসলামের পুনর্বিবেচনার আবেদন সুষ্ঠুভাবে শোনার পরিবেশ তৈরি হয়।
কৌশলগত আইনি পদক্ষেপ
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক (Barrister Abdur Razzaq) বিষয়টিকে বৃহত্তর আইনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারিক কাঠামোর ভিত্তি চ্যালেঞ্জ করতে হবে, যার সূচনা হয় আব্দুল কাদের মোল্লার মামলার রায়ের মাধ্যমে। সে রায়ে বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য নয়। এটি একটি বিচার বহির্ভূত কাঠামো তৈরি করে।
পুনর্বিবেচনার আবেদন ও আইনি যুক্তি
পুনর্বিবেচনার আবেদনে চারটি নতুন আইনি যুক্তি তুলে ধরা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিটি ছিল, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ক্ষেত্রে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করা হয়নি। এর মাধ্যমে কেবল আজহারুল ইসলামের রায় নয়, বরং কাদের মোল্লাসহ অন্যান্য রায়ের বৈধতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
ফুল কোর্টে শুনানি ও রায়
ব্যারিস্টার রাজ্জাকের আবেদনের ভিত্তিতে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চে শুনানি হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। মাত্র একদিনের শুনানির পর আদালত স্বীকার করেন যে, আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা একটি গুরুতর ত্রুটি ছিল। ফলে রিভিউ আবেদন মঞ্জুর হয় এবং মৃত্যুদণ্ড বাতিল করা হয়।
**(লেখক: ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিক (Barrister Ehsan A Siddiq), বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কৌঁসুলি। তিনি মরহুম ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের পুত্র।)