বাংলাদেশ রেলওয়ে (Bangladesh Railway)–তে গত ১৬ বছরে মেগা প্রকল্পের নামে সংঘটিত দুর্নীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন (Toma Construction) ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড (Max Infrastructure Ltd)। এই দুই প্রতিষ্ঠানের পেছনে ছিল আওয়ামী লীগ (Awami League)–এর প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম (Mirza Azam)–এর ছত্রছায়া।
রাজনৈতিক প্রভাবেই ঠিকাদারি রাজত্ব
তমার মালিক আতাউর রহমান মানিক (Ataur Rahman Manik) ও ম্যাক্সের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর (Golam Mohammad Alamgir) আওয়ামী লীগের প্রভাব কাজে লাগিয়ে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার রেল প্রকল্পের কাজ আদায় করেন। এ কাজ আদায়ে রেল মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও ‘সহযোগী’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
মেগা প্রকল্পে দুর্নীতির ছড়াছড়ি
রেলের বড় প্রকল্পগুলোর অধিকাংশেই তমা-ম্যাক্স সরাসরি বা যৌথভাবে অংশ নেয়। এর মধ্যে রয়েছে—রাজবাড়ী-টুঙ্গিপাড়া, ঈশ্বরদী-ঢালারচর, দোহাজারী-কক্সবাজার, লাকসাম-আখাউড়া এবং কাশিয়ানী-গোপালগঞ্জ রেলপথ।
প্রতিটি প্রকল্পে ব্যয় ও মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে শত শত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। যেমন টুঙ্গিপাড়া রেল প্রকল্পে অনুমোদিত ব্যয় ১,১০১ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২,০৩৫ কোটি টাকা করা হয় এবং ৯৩৪ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়। কেবল মাটি ভরাটেই লোপাট হয় প্রায় ৯০০ কোটি টাকা।
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ
রেলের সাবেক মহাপরিচালক শামছুজ্জামান স্বীকার করেছেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ঠিকাদার নির্বাচনে স্বচ্ছতা নষ্ট হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদনের আগেই পরিকল্পনা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সচিবদের মাধ্যমে অনুমোদন আদায় করে নিত দুই প্রতিষ্ঠান।
সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্প
বুয়েট (BUET) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেছেন, সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ দুর্নীতির বড় উদাহরণ। প্রকল্প বরাদ্দের ৭০-৭৫% অর্থ লোপাট করা হয়।
তমা-ম্যাক্সের ব্যক্তিগত লাভ
গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ, এলসি জালিয়াতির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানদ্বয়ের বিরুদ্ধে। এক প্রকৌশলীকে রাজি না হওয়ায় লাঞ্ছিতও করা হয়।
মির্জা আজম ও মানিকের সম্পর্ক
আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজমের আশীর্বাদেই তমার মালিক মানিক বিশাল ব্যবসায়ী ও ক্রীড়া সংগঠকে পরিণত হন। তিনি নোয়াখালী (Noakhali) জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদও বাগিয়ে নেন। ভোটে হেরে এখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
ম্যাক্স চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার
ম্যাক্স চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ আলমগীরকে ২০২৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে দুদক (ACC)। প্রায় ২৮ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তদন্তে দেখা গেছে, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও রেলের একাধিক প্রকল্পে এককভাবে ৩০ হাজার কোটি টাকার কাজ পেয়েছে ম্যাক্স।
প্রকল্প নথিতে অসংগতি
দোহাজারী-কক্সবাজার, কাশিয়ানী-গোপালগঞ্জ, আখাউড়া-লাকসামসহ বিভিন্ন প্রকল্পের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, একই প্রকৃতির কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলেও প্রকল্প দেওয়া হয়েছে ম্যাক্সকে। এটি পরিষ্কারভাবে অনৈতিক ও ক্ষমতার অপব্যবহার বলে মনে করছে দুদক।