অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus)–এর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের দশ মাসের মাথায় তাদের প্রথম বাজেট ঘোষণা করেছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম।
এই বাজেট উপস্থাপন করেন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ (Salehuddin Ahmed)। বাজেট ঘোষণার সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ স্থবিরতা, বিদেশি ঋণের চাপ, এবং রাজস্ব ঘাটতির মতো বড় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে দেশের অর্থনীতি।
বাজেটের কাঠামো ও সমালোচনা
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই বাজেট কাঠামোগতভাবে অনেকটাই পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সরকারের মতো। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)–এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান (Dr. Selim Raihan) বলেন, “সরকারের সামনে একটি ভিন্নধর্মী বাজেট উপস্থাপনের সুযোগ ছিল, যা তারা কাজে লাগাতে পারেনি।”
বাজেটে করহার বাড়ানোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আয়করদাতার সংখ্যা না বাড়িয়ে বিদ্যমান করদাতাদের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে।”
অন্যদিকে, অর্থ উপদেষ্টা বাজেটকে ‘ব্যতিক্রমধর্মী’ উল্লেখ করে বলেন, “এই বাজেট প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিয়েছে।”
জিডিপি ও মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা
আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫.৫ শতাংশ। সরকার আশা করছে এটি মধ্যমেয়াদে ৬.৫ শতাংশে উন্নীত হবে। মূল্যস্ফীতির হার ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনারও লক্ষ্য রাখা হয়েছে।
তবে বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
কর কাঠামো ও ব্যক্তিশ্রেণির প্রভাব
ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে (৩.৫ লাখ টাকা)। ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরে এটি ধাপে ধাপে বাড়িয়ে ৩.৭৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে।
বিশেষ শ্রেণির জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা:
– নারী ও ৬৫ বছরোর্ধ্ব: ৪ লাখ টাকা
– তৃতীয় লিঙ্গ ও স্বাভাবিক করদাতা: ৪.৭৫ লাখ টাকা
– গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা: ৫ লাখ টাকা
– জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ‘জুলাই যোদ্ধা’: ৫.২৫ লাখ টাকা
তবে কর হার কমানোর পরিবর্তে ধাপে ধাপে আয়ের ওপর বাড়তি কর আরোপ করা হয়েছে, যার ফলে অনেক করদাতার ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হবে।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল
বাজেটে পূর্বের ধারাবাহিকতায় কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে, যা নিয়ে সমালোচনা করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) (TIB)।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান (Dr. Iftekharuzzaman) বলেন, “এই সিদ্ধান্ত অনৈতিক, বৈষম্যমূলক এবং সংবিধানবিরোধী। এটি দুর্নীতিকে উৎসাহ দেবে ও সৎ উপার্জনকারীদের বঞ্চিত করবে।”
বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এ বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জগুলো হলো—
– মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
– ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি
– কর্মসংস্থান সৃষ্টি
– রাজস্ব আদায় বাড়ানো
– সামাজিক বৈষম্য হ্রাস
কিন্তু এই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি বলে বিশ্লেষণ তাঁদের।
প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ও ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ১৫.৪৪ শতাংশ।
বাজেট উপস্থাপনের প্রক্রিয়া
চলতি বছর সংসদ না থাকায় রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে বাজেট ঘোষণা করা হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের ৫৪তম বাজেট।