৭২টি দেশে ১৫১ সফরের পরও কূটনৈতিকভাবে ‘বন্ধুহীন’ নরেন্দ্র মোদি

চার দিনের সীমান্ত উত্তেজনার পর ভারত সরকারের ‘বিজয়োল্লাস’ ও ‘অপারেশন সিন্দুর’ ঘোষণাকে ঘিরে যখন ঘরোয়া রাজনীতিতে উল্লাস, তখনই আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারতের একঘরে হয়ে পড়ার বিষয়টি গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) ৭২টি দেশে ১৫১ বার সফর করলেও ভারতের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়নি কোনো দেশ। এই ব্যর্থতার পেছনে পররাষ্ট্রনীতির এককেন্দ্রিকতা ও রাজনৈতিক প্রচারণা নির্ভর কৌশলকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।

আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাবেই ‘বিজয়োল্লাসে’ ভাটা?

১৬ই মে, ভারত সরকার ঘোষণা দেয়—তারা ৩২টি দেশে ৫৯ জন এমপিকে পাঠাবে ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান ব্যাখ্যা করতে। যদিও সরকার বলছে এটি যুদ্ধজয়ের স্বীকৃতি, বিশ্লেষকরা বলছেন এটি মূলত আন্তর্জাতিক সমর্থন সঙ্কট থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টা। প্রশ্ন উঠছে—যদি ভারত সত্যিই জয়লাভ করে থাকে, তাহলে এত ব্যাখ্যার প্রয়োজন কেন?

বিরোধী দল নিয়েও বিতর্ক

বিদেশ সফরকারী প্রতিনিধি দলে বিরোধী দলের সদস্যরাও ছিলেন। তবে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ঘিরে শুরু হয়েছে বিতর্ক। কংগ্রেসের প্রস্তাবিত সদস্যদের বাদ দিয়ে শশী থারুরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যিনি এর আগেও দলীয় আদর্শবিরোধী বক্তব্যের কারণে সমালোচিত ছিলেন। অনেক দল—যেমন তৃণমূল কংগ্রেস (Trinamool Congress) এবং শিবসেনা (Shiv Sena)—শুরুতে প্রতিনিধি দলে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানালেও, পরে রাজনৈতিক চাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব করতে বাধ্য হয়।

মোদির ব্যক্তিকেন্দ্রিক কূটনীতি ও তার ব্যর্থতা

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদির পররাষ্ট্রনীতি ব্যক্তি-নির্ভর হয়ে ওঠে। ‘নমস্তে ট্রাম্প’, জি২০ সম্মেলনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্টে নরেন্দ্র মোদি নিজেকে বিশ্বনেতা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু এই প্রচারণা আন্তর্জাতিক সংকটে কোনও কার্যকর সমর্থন আনতে পারেনি। এমনকি মোদি ১০ বার যুক্তরাষ্ট্র (United States) সফর করলেও, যুক্তরাষ্ট্রসহ কোনও দেশই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়নি।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: সমতা বজায় রাখার আহ্বান

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব নিরুপমা রাও (Nirupama Rao) জানান, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ায় সবাই শুধু ‘উভয়পক্ষ সংযম দেখাক’ এই বার্তা দিয়েছে। এতে পাকিস্তান (Pakistan)কে সমকক্ষ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ফলে ভারতের যুদ্ধজয়ের প্রচারণা আন্তর্জাতিক মহলে প্রত্যাশিত গুরুত্ব পায়নি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে দ্ব্যর্থকতা

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর (S. Jaishankar) নিজেও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। একবার বলেছেন পাকিস্তানকে আগেই আক্রমণের কথা জানানো হয়েছিল, পরে বলেছেন পরে জানানো হয়। এই অস্পষ্টতা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির দুর্বলতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।

রাহুল গান্ধীর প্রশ্ন

কংগ্রেস (Congress) নেতা রাহুল গান্ধী (Rahul Gandhi) তিনটি প্রশ্ন তুলেছেন—
১. ভারতকে কেন পাকিস্তানের সঙ্গে একই পাল্লায় রাখা হচ্ছে?
২. কেন কোনও দেশ পাকিস্তানকে দায়ী করেনি?
৩. যুক্তরাষ্ট্র তথা ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকাই বা কী ছিল?

বিশ্লেষকদের মতে, ব্যক্তি-নির্ভর পররাষ্ট্রনীতি ভারতের ঐতিহ্যবাহী সম্মিলিত কূটনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে। ফলত ৭২টি দেশে ১৫১ সফর করেও প্রধানমন্ত্রী মোদি আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রকৃত বন্ধু খুঁজে পাননি।