রাখাইনে করিডর নিয়ে গুজব ‘চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প’—প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস

রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর নিয়ে প্রচারিত খবরকে ‘চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus)। শুক্রবার (৬ জুন) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব মন্তব্য করেন।

করিডর বিষয়ে গুজব ও অপপ্রচারের জবাব

ড. ইউনূস বলেন, “রাখাইন–এর জন্য বাংলাদেশ করিডোর দিয়ে দিয়েছে”—এমন অপপ্রচার সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, “এটা চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প। যারা মিথ্যা গল্প বানিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করছে, অশান্তি সৃষ্টিতে নিয়োজিত, এটা তাদেরই কল্পকাহিনী।”

তিনি জানান, জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেজ (Antonio Guterres) গত মার্চে ঢাকা সফরে রাখাইনে ত্রাণ সরবরাহের একটি মানবিক চ্যানেলের প্রস্তাব দেন, যা এখনও ‘প্রস্তাব’ পর্যায়েই রয়েছে।

করিডর বিতর্ক: কীভাবে শুরু

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান (Khalilur Rahman) প্রথম ৮ এপ্রিল করিডর প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, এরপর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন (Touhid Hossain) বলেন, সরকার ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে। এরপর বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক তৈরি করে।

সেনা সদর (Army Headquarters) থেকেও জানানো হয়, জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কোনো বিষয়ে সেনাবাহিনী সম্পৃক্ত হবে না। পরে সংবাদ সম্মেলনে খলিলুর রহমান দাবি করেন, করিডর নিয়ে কারও সঙ্গে সরকারের আলোচনা হয়নি এবং হবে না।

রোহিঙ্গা সংকট ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন

ড. ইউনূস বলেন, “আমাদের দেশে বর্তমানে ১২ লাখ রোহিঙ্গা (Rohingya) বসবাস করছেন। ২০২৩-২৪ সালে প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইনের যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।”

তিনি জানান, রোহিঙ্গা ইস্যুটি একসময় আন্তর্জাতিক এজেন্ডা থেকে ঝরে পড়েছিল, কিন্তু বর্তমান সরকার তা পুনরায় বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে আনতে সক্ষম হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আহ্বান জানানো হয় এবং সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে সেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান ইউনূস।

প্রত্যাবাসনে অগ্রগতি

তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার বিমসটেক (BIMSTEC) সম্মেলনের সময় ঘোষণা করেছে, তারা ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত মনে করে। সরকার এই বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গেও আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ করছে।

‘১৬ বছরের লুটপাটতন্ত্র অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে’

ড. ইউনূস বলেন, সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশের অর্থনীতি ছিল ভয়াবহ অবস্থায়। “যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেও এতটা খারাপ অবস্থা দেখা যায় না,” বলেন তিনি।

ইতিবাচক পরিবর্তন ও বাজেট পরিকল্পনা

তবে আশার কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, ব্যাংকসহ অধিকাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল হয়েছে। তিনি বলেন, “অর্থনীতির ইতিবাচক ধারা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করছে।”

তিনি বলেন, এবারের বাজেট হবে জনকল্যাণমুখী ও প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক নয়। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে কম হয়েছে।

রেমিটেন্স ও রপ্তানিতে অগ্রগতি

ড. ইউনূস বলেন, রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের ‘রেমিটেন্স যোদ্ধা’ হিসেবে কৃতজ্ঞতা জানান।

রাজস্ব ব্যবস্থা পুনর্গঠন

তিনি বলেন, রাজস্ব ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কারের অংশ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) (NBR) ভেঙে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ নামে দুটি স্বাধীন ইউনিট গঠন করা হয়েছে। এতে রাজস্ব আদায় কার্যকর হবে এবং দুর্নীতি হ্রাস পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।