সরকারি অর্থে হজে যাচ্ছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মালি, গাড়িচালক ও পিয়ন; উপেক্ষিত নির্দেশনা, উপদেষ্টার স্ত্রী ও দুই বোন সফরসঙ্গী

হজ ব্যবস্থাপনার নামে সরকারি অর্থে সৌদি আরবে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের হজ টিমে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে হজ সফরে ধর্ম উপদেষ্টার স্ত্রী ও দুই বোনকে সফরসঙ্গী করা হয়েছে। ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় (Ministry of Religious Affairs) সূত্র বলছে, এসব অনিয়ম হজ ব্যবস্থাপনায় সরকারিভাবে দীর্ঘদিন ধরে চলমান অপচয়ের ধারাবাহিকতা বহন করছে।

২৯৩ সদস্যের বিশাল হজ টিমে মালি-গানম্যান-পিয়ন

চলতি বছর পাঁচটি হজ টিমে মোট ২৯৩ জন সদস্য সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন মালি, গাড়িচালক, অফিস সহায়ক, গানম্যান, কম্পিউটার অপারেটর, সাঁট মুদ্রাক্ষরিকসহ বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারী। তাদের অনেকেই প্রথমবারের মতো হজে যাচ্ছেন এবং হজ সেবার অভিজ্ঞতা নেই বলেও জানা গেছে।

ধর্ম মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, হাজিদের সহায়তার জন্য নীতিমালা অনুসরণ করেই এসব জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। তবে হজ ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, এসব সেবা সৌদি সরকারই হজ প্যাকেজের আওতায় দিয়ে থাকে, ফলে বাংলাদেশ সরকারের এই বিশাল বহর সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ও অপচয়মূলক।

প্রধান উপদেষ্টার নিষেধ অমান্য করে সফরসঙ্গী স্ত্রীরাও

গত ২৩ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বিদেশ সফরে পরিবারের সদস্যদের সফরসঙ্গী করা যাবে না—এ মর্মে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন (Dr. A F M Khalid Hossain) তাঁর স্ত্রী কামরুন্নেসা হাসিনা ও দুই বোন খন্দকার উম্মে সালমা ও আরিফা মাহবুবাকে সফরসঙ্গী করেছেন। পাশাপাশি, অতিরিক্ত সচিব মো. ফজলুর রহমান (Md. Fazlur Rahman)-এর স্ত্রী মোরশেদা পারভীনও হজে গেছেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয় বলছে, তারা নিজেদের খরচে গেছেন। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনায় এমন সফর নিষিদ্ধ করা হয়েছে—ফলে বিষয়টি প্রশাসনিক নীতিমালার লঙ্ঘন বলেই দেখা হচ্ছে।

টিমে থাকা কর্মচারীদের নাম

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ টিমে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন—গাড়িচালক আক্তারুজ্জামান সরকার, টিটু মিয়া ব্যাপারী, মো. বাকিউল আলম, নুর মোহাম্মদ, মো. জাহাঙ্গীর আলম, আবদুর রহিম, মো. আলমগীর হোসেন, শামীম হোসেন, মো. সালাহউদ্দিন; অফিস সহায়ক মনিরুল ইসলাম, মো. আশরাফুল ইসলাম, মো. আরমান, তানিয়া আক্তার, আনোয়ার হোসেন, মো. সোহাগ, ইমন মিয়া, সারোয়ার মাহমুদ; কম্পিউটার অপারেটর শাহাদাত হোসেন; অফিস সহকারী সুরাইয়া খাতুন; সাঁট মুদ্রাক্ষরিক মধুমালা, আমিনুল ইসলাম, ফারজানা সুলতানা, মমিনুল ইসলাম; গানম্যান সাইফুল হক, শাহ আলম; এবং জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররম (Baitul Mukarram)-এর খাদেম মো. আবদুল মান্নান।

হজ এজেন্সির অভিযোগ ও হতাশা

হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) (Hajj Agencies Association of Bangladesh – HAAB)–এর কয়েকজন সাবেক নেতা জানান, তারা নতুন সরকারের কাছে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা আশা করলেও বাস্তবে পুরনো অনিয়মই বহাল রয়েছে। তাদের অভিযোগ, সরকারিভাবে হজে যাওয়া যাত্রীদের সেবার মান অত্যন্ত দুর্বল। এমনকি গাইড হিসেবে যাঁদের পাঠানো হয়, অনেকেই জীবনে প্রথমবার হজে যাচ্ছেন।

তাদের মতে, সরকারিভাবে যারা হজে যান, তাদের রান্নাবান্না, আবাসনসহ নানা বিষয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয়, যেখানে বেসরকারিভাবে যাওয়া হাজিদের সেবা নিশ্চিত করে সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলো।

টিআইবি বলছে—অপচয় বন্ধ হোক

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) (Transparency International Bangladesh – TIB)–এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান (Dr. Iftekharuzzaman) বলেন, “হজ ব্যবস্থাপনার নামে বিশাল বহর নিয়ে যাওয়া নিছক অপচয়। সৌদি সরকারের হজ প্যাকেজেই তো সব সেবা অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ সরকার সেই সুবিধা না নিয়ে বরং ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে অপ্রয়োজনীয় লোক পাঠাচ্ছে। এসব কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।”

ধর্ম উপদেষ্টার ব্যাখ্যা

ধর্ম উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন বলেন, “কম্পিউটার অপারেটর, অফিস সহায়ক ও অফিস সহকারী প্রয়োজন হয় কারণ মক্কা, মদিনা ও জেদ্দায় তিনটি অফিস খোলা থাকে। সেখানে হাজিদের সমস্যা সমাধান, দাফন, মেডিকেল সেন্টারে পৌঁছে দেওয়া, আবাসন তদারকি, অভিযোগ খতিয়ে দেখা ইত্যাদি কাজ করেন এ কর্মীরা।”

তবে সমালোচকদের প্রশ্ন, এসব কাজ সৌদি কর্তৃপক্ষ যখন প্যাকেজেই করছে, তখন বাংলাদেশ সরকারের এত ব্যয়বহুল ব্যবস্থাপনার যৌক্তিকতা কী?