চট্টগ্রামের তালসরা দরবার (Talsara Darbar) থেকে দুই কোটি সাত হাজার টাকা লুটের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাকে ঘিরে প্রকাশ পেয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ২০১১ সালের ৪ নভেম্বর র্যাব-৭ (RAB-7) এর অভিযানে পাঁচজন মিয়ানমারের (Myanmar) নাগরিককে আটক করা হলেও পরে মাজার থেকে অর্থ লুটের অভিযোগ আনা হয়।
তদন্তের বরাতে জানা গেছে, সে অভিযানের সময় র্যাব কর্মকর্তারা কোনো টাকা উদ্ধার করেননি; বরং তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে মামলা সাজানো হয়। মামলার প্রধান অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন র্যাব-৭ এর তৎকালীন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ জুলফিকার আলী মজুমদার (Lt. Col. Mohammad Zulfiqar Ali Majumder), কোম্পানি কমান্ডার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শেখ মাহমুদুল হাসান (Flt. Lt. Sheikh Mahmudul Hasan), ডিএডি আবুল বাশার (DAD Abul Bashar), এসআই তরুণ কুমার বসু (SI Tarun Kumar Basu) ও র্যাবের তিন সোর্স।
সাজানো নাটকের পেছনে জিয়াউল আহসান
জানা গেছে, র্যাব সদর দপ্তরের তৎকালীন ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক জিয়াউল আহসান (Ziaul Ahsan) চট্টগ্রামের কয়েকজন বিএনপি (BNP)-জামায়াত (Jamaat) নেতার বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। তবে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার তা মানতে অস্বীকৃতি জানানোর পর থেকেই তাকে ও তার দলকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়।
জুলফিকার অভিযোগ করেন, সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জিয়াউল ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ (Awami League) নেতার মদদে তাকে র্যাব থেকে সরিয়ে দিতে ষড়যন্ত্র করা হয়। তিনি জানান, অভিযানে অবৈধভাবে থাকা মিয়ানমার নাগরিকদের গ্রেপ্তার করা হলেও অর্থ লুটের কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কর্মকর্তাদের নির্যাতন
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাহমুদুল হাসান বলেন, জিয়াউল তদন্ত চলাকালে তাদের কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে সাজানো মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেন। পরে তাদের সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে গোপন কারাগারে ২০-২২ দিন আটকে রাখা হয় এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়।
এসআই তরুণ কুমার বলেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাদের জবানবন্দি গ্রহণের জন্য যে ম্যাজিস্ট্রেটের কথা বলেন, তাকে তিনি কোনোদিন দেখেননি।
তদন্ত প্রতিবেদন এবং বিচার প্রক্রিয়া
মাজার লুট সংক্রান্ত ঘটনায় পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় – র্যাব, সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী (Air Force), বিজিবি (BGB) ও পুলিশ (Police)। তবে শুধু র্যাবের অভ্যন্তরীণ তদন্তে টাকা লুটের প্রমাণ পাওয়া গেলেও অন্য তদন্তে তা প্রমাণ হয়নি।
দুদক (ACC) অনুসন্ধানেও লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকারের বিরুদ্ধে কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। মামলার বাদী পরবর্তীতে মামলা প্রত্যাহারের শর্তে অর্থ দাবি করলেও সেটি প্রত্যাখ্যান করা হয়।
মূল অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার
প্রসঙ্গত, ষড়যন্ত্রের নেপথ্য কুশীলব হিসেবে চিহ্নিত জিয়াউল আহসানকে গত ১৫ আগস্ট রাতে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর পাঁচদিন পর গ্রেপ্তার হন রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ সোহায়েল (Rear Admiral (retd.) Mohammad Sohail)। দুজনের বিরুদ্ধেই দুর্নীতি, গুম এবং ২০২৩ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। তারা বর্তমানে কারাগারে আছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের দাবি
র্যাব-৭-এর সাবেক কর্মকর্তারা দাবি করেন, মিথ্যা মামলার কারণে তাদের চাকরি হারাতে হয়েছে, সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়েছে। যদিও অনেকেই নিজ নিজ বাহিনীতে বিভাগীয় মামলায় বিজয়ী হয়েছেন, এখনও বাহিনীতে পুনরায় যোগদানের সুযোগ পাননি।
তারা বলেন, দেশের সশস্ত্র বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে এবং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই এসব ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। তারা বিচার দাবি করেন এবং তাদের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান।