পাচারকারীদের সঙ্গে সমঝোতার লক্ষ্য টাকা উদ্ধার, শাস্তি নয়: গভর্নর আহসান এইচ মনসুর

বাংলাদেশ ব্যাংক (Bangladesh-Bank) গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর (Ahsan-H-Mansur) বলেছেন, অর্থ পাচারে জড়িতদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত কম দোষী, তাদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে টাকা উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হবে। মূল লক্ষ্য শাস্তি নয়, বরং অর্থ ফেরত আনা।

ব্যাংক খাত সংস্কারে স্বায়ত্তশাসন ও নেতৃত্বের গুরুত্ব

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে রাজনৈতিক চাপমুক্ত ও কার্যকরভাবে পরিচালনা করা যাবে। স্বচ্ছ, দক্ষ ও নিরপেক্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনের ওপর জোর দেন গভর্নর, যেখানে যোগ্য ব্যক্তিরাই নেতৃত্বে আসবেন।

দুর্নীতি দমনে জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম

পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করা হয়েছে। এই টিম দেশের ভেতরে ও বাইরে তদন্ত চালাচ্ছে। যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। বিদেশি ল ফার্ম নিয়োগের প্রস্তুতি চলছে, যারা সম্পদ ফেরাতে আইনি লড়াইয়ে অংশ নেবে।

পাচারকারীদের সঙ্গে সমঝোতার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা

গভর্নর ব্যাখ্যা করেন, সিভিল মামলার আওতায় যেসব আর্থিক অপরাধ পড়ছে, সেখানে সমঝোতার মাধ্যমে টাকা উদ্ধার করাই মুখ্য লক্ষ্য। কেবলমাত্র শাস্তির পথে গেলে অনেক সময় অর্থ ফেরত আসে না। তাই আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সমঝোতা করা হতে পারে। তবে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার এবং মামলার আইনি শক্তিমত্তা বিবেচনায়।

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ: নতুন ব্যাংকের পরিকল্পনা

পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করে নতুন শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠন করা হবে। একীভূতকরণে কর্মী ছাঁটাই নয়, বরং দক্ষ কর্মীদের ধরে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রযুক্তি ও শাখা সমন্বয় ধাপে ধাপে হবে। একই সঙ্গে অযোগ্য নিয়োগ বন্ধে পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়ন চালু করা হয়েছে।

ব্যাংক খাত সংস্কারে পূর্বের ব্যর্থতা ও আইনি প্রস্তুতি

পূর্ববর্তী সরকারের সময় একীভূতকরণে আইনি কাঠামোর অভাব ছিল। এখন আইন সংশোধন করা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে আছে। ‘ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স অ্যাক্ট’ ও ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি আইন’ প্রণয়ন হচ্ছে।

বিনিয়োগ বাড়াতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্ব

বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও পূর্বানুমানযোগ্য নীতি চালুর ওপর জোর দেন গভর্নর। লন্ডনের সাম্প্রতিক বৈঠক এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে।

আগের সরকারের দুর্নীতি তদন্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থান

দুর্নীতি দমন কমিশন (Anti-Corruption-Commission), সিআইডি ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ওপর তদন্তের দায়িত্ব বর্তায় বলে জানান গভর্নর। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবে। জরিমানার সীমা বাড়িয়ে আইনি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্তির চিন্তা

১৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় আছে। এদের লিকুইডেশনের চিন্তা করছে সরকার। গ্রাহকদের ক্ষতি কমাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। দেশে এতগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ছিল না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

নগদ নিয়ে সংস্কার পরিকল্পনা

নগদ (Nagad) থেকে অসাধু চক্রকে সরিয়ে একটি কৌশলগত বিনিয়োগকারীর হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। অডিটে ৬৩০ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে। বর্তমান অবস্থা ধরে রেখে ভবিষ্যতে শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম গঠনের চেষ্টা চলছে।

ব্যক্তিগত সম্পদের বিষয়ে ব্যাখ্যা

নিজের মেয়ের সম্পদের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি তার ব্যক্তিগত বিষয়। কেউ যদি প্রমাণ দেখাতে পারে, তাহলে সেটি আইনি পথে দেখা হবে।

আইএমএফ ঋণ বিষয়ে অবস্থান

২৩ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) বৈঠকে অর্থ ছাড়ের বিষয়ে তিনি বলেন, চাপের মুখে নয়, বরং সময়মতো প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমেই এগোচ্ছেন। রিজার্ভে চাপ নেই, আর আইএমএফের টাকার ওপর নির্ভরশীলতা কমেছে।

অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা

তিনি বলেন, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার মতো সংকট এড়ানো গেছে সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়ায়। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বেড়েছে, রিজার্ভও বাড়ছে। বর্তমানে তা ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার প্রত্যাশা

মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে জ্বালানির দাম কিছুটা অনিশ্চিত হলেও, খাদ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। আগস্টের পর মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।