আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে উঠে এসেছে দেশের ব্যাংক খাত পুনর্গঠন। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংক খাত এক গভীর সংকটে পড়ে, যার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরপর তিনজন গভর্নর—আতিউর রহমান (Atiur Rahman), ফজলে কবির (Fazle Kabir) এবং আবদুর রউফ তালুকদার (Abdur Rouf Talukder)। যদিও তাঁদের বিরুদ্ধে অনিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে, তবে তাঁরা কেউই এখন পর্যন্ত জবাবদিহির আওতায় আসেননি।
ব্যাংক খাত: ‘ব্ল্যাকহোল’ হিসেবে অভিহিত
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ব্যাংক খাতকে ‘ব্ল্যাকহোল’ বলে অভিহিত করেছে। কমিটির তথ্যানুযায়ী, দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকায় এবং ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা।
আতিউর রহমান: অনিয়মের সূচনা ও বিতর্কিত সিদ্ধান্ত
২০০৯ সালে গভর্নরের দায়িত্বে আসা অধ্যাপক আতিউর রহমান (Atiur Rahman)–এর সময়ে সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। একই সময় আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ নয়টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে রাজনৈতিক প্রভাবে বেক্সিমকোসহ একাধিক গ্রুপকে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। পরে রিজার্ভ চুরির ঘটনার দায় নিয়ে ২০১৬ সালে পদত্যাগ করেন।
ফজলে কবির: দখল ও লুটপাটের বৈধতা
ফজলে কবির (Fazle Kabir) ২০১৬ সালে গভর্নর নিযুক্ত হন। তাঁর সময়েই ইসলামী ব্যাংক (Islami Bank) ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংক দখল করে নেয় এস আলম গ্রুপ (S. Alam Group)। গভীর রাতে বাসায় বসে এই দখলের অনুমোদন দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ঋণনীতিতে ছাড় দিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ খেলাপি হওয়ার পথ সুগম করেন তিনি। তাঁর মেয়াদ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছরে উন্নীত করে তৎকালীন সরকার।
আবদুর রউফ তালুকদার: টাকা ছাপানোর নীতি
২০২২ সালে গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন আবদুর রউফ তালুকদার (Abdur Rouf Talukder)। তাঁর সময় অর্থ পাচার আরও বৃদ্ধি পায়। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর ঘাটতি পূরণে তিনি বিপুল পরিমাণে টাকা ছাপান, যেগুলো পরবর্তীতে এস আলম গ্রুপ ও তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠরা ঋণের নামে তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করে। তাঁর আমলেই বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় এবং আর্থিক তথ্য গোপন রাখা শুরু হয়। সরকারের পতনের পর তিনি আত্মগোপনে যান এবং পরে পদত্যাগ করেন।
১০ বিলিয়ন ডলার পাচার
বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর (Ahsan H. Mansur) সম্প্রতি ফিন্যান্সিয়াল টাইমস (Financial Times)–কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, এস আলম গ্রুপ অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। যা প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ।
এখনো অধরা জবাবদিহি
অথচ এই তিন গভর্নরের বিরুদ্ধে বিপুল অনিয়ম ও অর্থ পাচারের অভিযোগ থাকলেও কেউই আজ পর্যন্ত আইনি জবাবদিহির মুখোমুখি হননি। আতিউর রহমান ও ফজলে কবির-এর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাঁদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। আবদুর রউফ তালুকদার আত্মগোপনে রয়েছেন। নতুন সরকার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান তদন্ত শুরু হয়নি। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত যখন ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায়, তখন সেই ধ্বংসের নেপথ্যের চরিত্ররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকাই আজ দেশের জন্য সবচেয়ে বড় আর্থিক ট্র্যাজেডি।