বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি নিয়ে এক বিস্তৃত অনুসন্ধানে উঠে এসেছে সাবেক মন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু (Nasrul Hamid Bipu)-র দুর্নীতির বিস্তার এবং তার পেছনে থাকা দুই গডফাদার—সজীব ওয়াজেদ জয় (Sajeeb Wazed Joy) ও রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি (Radwan Mujib Siddiq Bobby)।
শেখ হাসিনার নির্দেশ, পরিবারিক তদবিরে স্থগিত
২০১৭ সালের ২২ মার্চ বিদ্যুৎ বিভাগে সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. আহমদ কায়কাউস (Ahmad Kaikaus) বিপুর কিছু দুর্নীতির ফাইল দেখে চমকে ওঠেন। রাতেই তিনি তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina)-র সঙ্গে দেখা করে ফাইল উপস্থাপন করেন। এতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। প্রধানমন্ত্রী বিপুকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম (Shafiul Alam)-কে নির্দেশ দেন ব্যবস্থা নিতে।
তবে দ্রুতই খবর পৌঁছে যায় বিপুর কাছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকা জয় ও ব্যাংককে অবস্থানরত ববির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শেখ হাসিনার কাছে ফোন যায় জয় ও ববির পক্ষ থেকে। এরপর শেখ রেহানাও (Sheikh Rehana) হস্তক্ষেপ করেন। এই চাপের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ স্থগিত করেন এবং পরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি তুলে ধরেন।
লুটপাটের বিনিময়ে লাভবান ছিলেন পরিবারের সদস্যরা
তদন্তে উঠে এসেছে, বিপু তাঁর দুর্নীতির অর্থ থেকে ভাগ দিতেন জয়, ববি ও রেহানাকে। ববির পরিবারের খরচ চলত বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতির অর্থে। ২০১৭ সালের মার্চে ববি দেশে ফিরে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) (Center for Research and Information – CRI) অফিসে বৈঠক করেন বিপুর সঙ্গে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ‘লেটস টক’ নামে একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের, যার প্রকৃত খরচ ১০-১২ লাখ টাকা হলেও বিপু ১০ কোটি টাকার চেক দেন।
প্রামাণ্যচিত্র বানিয়ে দুর্নীতির বৈধতা
এরপর আরও বড় প্রকল্প নেয়া হয়, যেখানে ববির উদ্যোগে এশিয়াটিক (Asiatic)-এর নির্মাতা পিপলু খান (Piplu Khan)-কে দিয়ে শেখ হাসিনার জীবনের উপর প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হয়। প্রকৃত খরচ ২৫-৩০ লাখ হলেও বাজেট দেখানো হয় ২০ কোটি টাকা। পিপলু খান তিন কিস্তিতে ৮৫ লাখ ও পরে ১৫ লাখ নগদ পান, যা বিপু নগদে দেন। এই ছবির মাধ্যমে বিপুর দুর্নীতি ধামাচাপা পড়ে।
কায়কাউসকে ঘুষ দিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনা
ড. আহমদ কায়কাউস যখন বিপুর বিরুদ্ধে ফাইল আটকে দেন, তখন জয় ও ববি তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে ডেকে নেন। সেখানে বিপু তাঁকে একটি বিলাসবহুল বাংলো কিনে দেন, যা এক প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতার মাধ্যমে হস্তান্তর হয়। পরবর্তীতে কায়কাউস হন মুখ্য সচিব এবং তিনিও দুর্নীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন।
ববির ব্যাংকক ও জয়ের সিঙ্গাপুরে বাড়ি, ব্যবসায় বিনিয়োগ
বিপু ববির ব্যাংকক ও ফিনল্যান্ডের বাড়ি কেনেন এবং জয়ের সিঙ্গাপুর ব্যবসায় ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ করেন। জয়ের জন্য সিঙ্গাপুরের এক ক্রেডিট কার্ড পাওয়ারকোর ব্যাংক গ্যারান্টিতে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
গডফাদারদের ছত্রছায়ায় দুর্নীতির অভয়ারণ্য
সবশেষ ২০২৪ সালের “ডামি” নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নেন, বিপুকে তৃতীয় দফায় মন্ত্রী করবেন না। কিন্তু ববি ও জয়ের হস্তক্ষেপে তিনি সিদ্ধান্ত বদলান এবং এবার বিপুকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। ফলে পুরো খাতে জবাবদিহিহীনতা তৈরি হয় এবং লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়।