সড়ক ভবনে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ১৫ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান: মদদদাতা ছিলেন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা

২০১১-১২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) পরিচালিত প্রকল্পে ৮৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও এর ৯০ শতাংশের বেশি কাজ পেয়েছে মাত্র ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই চক্রের পেছনে ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক সাবেক প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য। তাদের প্রত্যক্ষ আশীর্বাদ ও কমিশনের বিনিময়ে কাজ ভাগাভাগি হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।

রাজনৈতিক আশীর্বাদে কাজ বণ্টন

সাবেক সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ফেনীর সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ও সাবেক চিফ হুইপ নুর-ই-আলম চৌধুরী লিটন-এর নাম উঠে এসেছে দরপত্র বাণিজ্যের নেপথ্যে। এ ছাড়া ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জা, স্ত্রী ইশরাতুন্নেছা কাদের ও নোয়াখালীর সাবেক এমপি একরামুল করিম চৌধুরী-র নামও রয়েছে এই বলয়ের সঙ্গে জড়িত হিসেবে।

কমিশনের বিনিময়ে কাজ বণ্টনের অভিযোগ

সওজের প্রকৌশলীদের একটি অংশ ও এসব প্রভাবশালী নেতাদের মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল প্রকৌশলী-ঠিকাদার সিন্ডিকেট। একটি প্রকল্পের কাজ পেতে ঠিকাদারদের গড়ে ১৫ শতাংশ কমিশন দিতে হতো। এককালীন ঘুষের ব্যবস্থাও ছিল।

১৫টি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকার কাজ

এই ১৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে—হাসান টেকনো বিল্ডার্স, রানা বিল্ডার্স, মোজাহার এন্টারপ্রাইজ, মো. মঈনউদ্দিন (বাঁশি), ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই) লিমিটেড, তাহের ব্রাদার্স, মোহাম্মদ আমিনুল হক লিমিটেড, মাসুদ হাইটেক, স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স, এমএস সালেহ আহমেদ, এমএম বিল্ডার্স, রিলায়েবল বিল্ডার্স, তমা কনস্ট্রাকশন, মাহফুজ খান লিমিটেড ও আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন।

রাজনৈতিক সম্পর্ক ও তদবিরে কাজ ভাগ

প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত। যেমন:
– হাসান টেকনো বিল্ডার্সের নাজমুল হাসান ও রানা বিল্ডার্সের মো. আলম মামা-ভাগ্নে।
– মাসুদ হাইটেকের জুলফিকার হোসেন ছিলেন শামীম ওসমান-এর ঘনিষ্ঠ।
– মোজাহার এন্টারপ্রাইজের মালিক কাজী মোজাহারুল ইসলাম, বাগেরহাটের সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিন-এর ঘনিষ্ঠ।
– এমএস সালেহ আহমেদ ছিলেন নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠ।
– রিলায়েবল বিল্ডার্সের শফিকুল আলম, শেখ ফজলুল করিম সেলিম-এর ঘনিষ্ঠ।
– তমা কনস্ট্রাকশনের মালিক আতাউর রহমান ভূঁইয়া ছিলেন মির্জা আজম ও ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ।
– মাহফুজ খান লিমিটেডের মালিক ছিলেন শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ-র ঘনিষ্ঠ।

এনডিই ও উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা

এনডিই ২০১৭ সাল থেকে ছয় বছরে সওজের সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেয়। তারিক আহমেদ সিদ্দিকের আশীর্বাদে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ড বহাল ছিল। দুর্নীতির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটিকে নিষিদ্ধ করা হলেও পরে তারা আদালতের স্থগিতাদেশে নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত হয়। এনডিইর কর্ণধার রায়হান মোস্তাফিজ ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে নুর-ই-আলম চৌধুরীর আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকায় কাজ বণ্টনে সুবিধা পেতেন বলে অভিযোগ।

টিআইবি’র প্রতিবেদন: প্রকল্প ব্যয়ের ২৩-৪০% দুর্নীতিতে

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র প্রতিবেদনে বলা হয়, ঠিকাদারি কাজে গড়ে ১০-২০ শতাংশ কমিশন দিতে হতো। প্রকল্প পরিকল্পনার শুরুতেই (ডিপিপি) অনিয়ম হতো। প্রকৌশলী ও ঠিকাদার মিলে সম্ভাব্যতা যাচাই, ব্যয় হিসাব ইত্যাদি সাজিয়ে তৈরি করতেন। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্যও ঘুষ দিতে হতো দুই থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত।

ডিপিপি অনুমোদনের আগেই ঠিক করা থাকত—কোন খাতে কত টাকা ‘বাঁচানো’ যাবে। প্রকল্প বাজেটের ২৫-৩০% বাড়িয়ে ধরা হতো দুর্নীতির লক্ষ্য পূরণে।

সংশ্লিষ্টদের দায় অস্বীকার ও প্রশাসনিক মন্তব্য

অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অভিযোগ অস্বীকার করে নিজেদের ওয়েবসাইটে বিবৃতি দিয়েছে। এনডিই বলেছে, “আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”

সওজের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী সোয়েব আহমেদ বলেন, “সরকারি বিধিমালা অনুসারেই কাজ দেওয়া হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়ম প্রমাণিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”