গুমসংক্রান্ত কমিশন (Enforced Disappearance Commission) এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে জানিয়েছে, বাংলাদেশে গুমের শিকার ব্যক্তিদের ওপর ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল শব্দনিরোধক কক্ষ। এসব কক্ষে র্যাব (RAB) ও ডিজিএফআই (DGFI) পরিচালিত নির্যাতনের ব্যবস্থাপত্র ছিল ভয়াবহ ও পদ্ধতিগত।
নির্যাতনের গোপন কক্ষ ও পদ্ধতি
মঙ্গলবার বিকেলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের শিকার মানুষদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল শব্দনিরোধক বিশেষ কক্ষ। এতে ছিল বৈদ্যুতিক শর্ট দেওয়ার চেয়ার, ঘূর্ণায়মান চেয়ার, হাত-পা বাঁধার রশি, নখ তুলে ফেলার যন্ত্রসহ নানা রকমের নির্যাতনের উপকরণ। র্যাব-২ (RAB-2) এর সিপিসি ৩ (CPC-3) এবং টিএফআই সেল (TFI Cell)-এ এসব যন্ত্র ব্যবহার করা হতো।
১০ ধরনের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন
গুম হওয়া ব্যক্তিদের ওপর চালানো হয় অন্তত ১০ ধরনের পদ্ধতিগত নির্যাতন। যেমন—
– সব সময় অস্বস্তিকর পরিবেশে রাখা
– অর্ধেক খাবার দেওয়া
– নিজ ভাগ্যের অনিশ্চয়তায় মানসিক যন্ত্রণা
– ঘুমানোর জায়গায় টয়লেট
– সিসিটিভি মনিটরিং
– নারীদের ক্ষেত্রে শরীর উন্মুক্ত করে হাত দুই পাশে বেঁধে রাখা
– পিরিয়ড চলাকালে প্যাড না দেওয়া ও উপহাস করা
– যমটুপি পরিয়ে বেধড়ক পেটানো
– নখ তুলে ফেলা, বৈদ্যুতিক শক, ওয়াটারবেডিং
– যৌন নির্যাতন ও প্রসবকালে বৈদ্যুতিক শক
নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র
২০১৭ সালে র্যাব-১১ (RAB-11) এক যুবককে অপহরণ করে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে তার পা ওপরে ঝুলিয়ে নির্যাতন করে। ২০২৩ সালে ডিএমপির (DMP) সিটিটিসি (CTTC) এক ব্যক্তিকে ১৪ দিন গুম করে টানা নির্যাতন করে। ২০২২ সালে আরেকজনকে ২৫৩ দিন আটকে রেখে চারটি শিফটে চালানো হয় নির্যাতন।
গুমের শিকার নারীরা ক্রুশবিদ্ধের মতো হাত বাঁধা, পিরিয়ড চলাকালীন প্রয়োজনীয় সামগ্রী থেকে বঞ্চিত হওয়া ও প্রহরীদের কটূ মন্তব্যের শিকার হন। একজন নারী জানান, ২০১৮ সালে তাকে ২৪ ঘণ্টা গুম করে ওই পরিস্থিতিতে আটকে রাখা হয়েছিল।
দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ক্ষতি
২০১৯ সালে র্যাব-৩ (RAB-3) ও গোয়েন্দা শাখা এক তরুণকে ২০ মাস ১৩ দিন গুম করে রাখে। র্যাবের নির্যাতনে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারান—একা হাসেন, কথা বলেন ও কাঁদেন।
কমিশনের পর্যবেক্ষণ
কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন (Nur Khan Liton) জানান, গুমের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ র্যাবের বিরুদ্ধে। নির্যাতনের পর সুস্থ হলে তাদের একটি সাজানো মামলায় জনসমক্ষে হাজির করা হতো।
কমিশনের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত মোট ১,৮৫০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ১,৩৫০টি যাচাই-বাছাই করা হয়েছে এবং এখনো নিখোঁজ ৩৪৫ জন।