গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ রেলওয়ে (Bangladesh Railway) খাতে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব প্রকল্পের বড় অংশেই নানাভাবে আর্থিক লোপাট ঘটেছে বলে বিভিন্ন তদন্তে উঠে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) ও তার বোন শেখ রেহানা (Sheikh Rehana)–এর ঘনিষ্ঠ মহল।
২০ হাজার কোটি টাকার রোলিং স্টক, অর্ধেকই অকেজো
রেলওয়ের রোলিং স্টক (লোকোমোটিভ, কোচ, ওয়াগন, লাগেজ ভ্যান, রিলিফ ট্রেন ও ক্রেন) কেনায় ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এসব উপকরণের অর্ধেকই বর্তমানে ব্যবহারের অযোগ্য। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কেনা ডেমু ট্রেনের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। অনেক ইঞ্জিন নামমাত্র গতি নিয়ে চললেও মাঝপথে বিকল হয়ে পড়ছে। ওয়াশিং প্ল্যান্ট সম্পূর্ণ অচল, লাগেজ ভ্যানও ব্যবহৃত হচ্ছে না।
প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ
দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে ৩০টি লোকোমোটিভ কেনার প্রকল্পে। প্রায় ১,২০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (Anti-Corruption Commission – ACC)। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন (Nurul Islam Sujan), রেলওয়ের মহাপরিচালক সামসুজ্জামান ও এডিজি মঞ্জুর-উর-আলম চৌধুরী। এই প্রকল্পে ৩০০ কোটি টাকা লোপাটের তদন্ত চলছে।
বিদেশ সফর, বিলাসিতা ও প্রমোদভ্রমণ
তদন্তে উঠে এসেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিদেশ সফর ও প্রমোদভ্রমণে মেতে উঠেছিলেন, যার মধ্যে পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন। এসব ব্যয়ে জনগণের বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও ফলাফল শূন্য।
অতিরিক্ত ব্যয়, মানহীন পণ্য
২০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ৬৭৮ কোটি টাকায় কেনা ১৫০টি মিটারগেজ কোচের প্রকৃত মূল্য ছিল প্রায় অর্ধেক। দুর্নীতিতে অতিরিক্ত ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
এছাড়া একাধিক প্রকল্পে ব্যয় ২-৩ গুণ বাড়ানো হয়েছে। অনেক ইঞ্জিন ৪২ কোটি টাকা, কোচ ৫ কোটি টাকা করে কেনা হলেও বাস্তবে এগুলোর পারফরম্যান্স অত্যন্ত হতাশাজনক।
নেপথ্যে রাজনৈতিক প্রভাব ও নির্দেশনা
রেলওয়ের অনেক প্রকল্পে ‘বিশেষজ্ঞ’ নিয়োগ করা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। প্রকল্প ও কেনাকাটার সিদ্ধান্ত এসেছে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে। অনেক সময় সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে একনেক (ECNEC)।
পরিকল্পনা ছাড়া বিশাল প্রকল্প, কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন
২০২৩ সালের শেষ দিকে রেলওয়ে আরও ৮০টি ইঞ্জিন ও শত শত কোচ, ওয়াগন ও লাগেজভ্যান সংগ্রহের জন্য ৬ হাজার কোটি টাকার নতুন প্রকল্প নেয়। অথচ এর আগের প্রকল্পগুলোর ফলাফল এখনও প্রশ্নবিদ্ধ।
ওয়াশিং প্ল্যান্ট: ৪০ কোটি টাকার যন্ত্র, এক বছরেই অকেজো
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা দুটি স্বয়ংক্রিয় ওয়াশিং প্ল্যান্ট এক বছরেই অকেজো হয়ে পড়ে। এ প্রকল্পে জড়িত ছিলেন তৎকালীন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফজলে করিম চৌধুরী (Fazle Karim Chowdhury) ও তার ছেলে ফারাজ করিম (Faraz Karim)।
রেলের বর্তমান অবস্থান
বর্তমান রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেছেন, “পরিকল্পনামাফিক না কেনায় রোলিং স্টক কাজে আসছে না। লাগেজ ভ্যানগুলো কাজে লাগিয়ে আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।”
বিশেষজ্ঞদের মত
বুয়েটের (BUET) অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক বলেন, “রেলে প্রতিটি প্রকল্পেই দুর্নীতি হয়েছে। সময় এসেছে জবাবদিহির আওতায় আনার।”
রেল উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, “দুর্নীতিতে জড়িতদের কেউ রেহাই পাবে না। তদন্ত চলছে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”