রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (National Consensus Commission) প্রথম দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত আলোচনার পর বেশ কয়েকটি প্রস্তাবে নীতিগত ঐকমত্য অর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। সোমবার (২৭ মে) জাতীয় সংসদ ভবনের (National Parliament Building) এলডি হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ (Ali Riaz)।
প্রথম দফায় যে প্রস্তাবে একমত
আলোচনার প্রথম পর্যায়ে যে বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে সেগুলো হলো—
– তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা
– দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) (Anti-Corruption Commission) সংস্কার
– সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয় (Supreme Court Secretariat) প্রতিষ্ঠা
আলী রীয়াজ বলেন, জুনের শুরুতে দ্বিতীয় দফার আলোচনা শুরু হবে এবং জুলাইয়ের মধ্যে একটি ‘জাতীয় সনদ’ চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।
এখনও যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য
তবে তিনি জানান, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ ও মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) (National Constitutional Council) গঠন, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের সীমা, সংসদ সদস্যদের একাধিক পদধারনের বিধান, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া, সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি।
সংসদীয় সংস্কার ও সংবিধান সংশোধন প্রস্তাব
- সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তনের প্রস্তাবে দলগুলো একমত হলেও কোন কোন বিষয়ে দলীয় চিহ্নযুক্ত ভোট বাধ্যতামূলক হবে, তা নিয়ে মতবিভেদ রয়ে গেছে।
- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের প্রস্তাবে অধিকাংশ দল একমত।
- সংরক্ষিত নারী আসন ১০০টি করা এবং ডেপুটি স্পিকারের পদ বিরোধী দলের প্রতিনিধি হিসেবে রাখার পক্ষে অধিকাংশ দলের সমর্থন রয়েছে।
- সংবিধানের ৪৮-(ক) অনুচ্ছেদ সংশোধনের ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে।
বিচার বিভাগ ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে—
– সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয় গঠন ও বিচারকদের চাকরির নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিমকোর্টের হাতে রাখার বিষয়টি দলগুলো সমর্থন করেছে।
– বিচারকদের রাজনৈতিক আনুগত্যকে অসদাচরণ হিসেবে বিবেচনা করার বিধানেও একমত হয়েছে দলগুলো।
– রাষ্ট্রপতির হাতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা বাতিল করে আপিল বিভাগের প্রবীণ বিচারক অথবা শীর্ষ তিনজনের মধ্য থেকে নির্বাচন করার প্রস্তাবে একমত।
নির্বাচন ও রাষ্ট্রপতি প্রক্রিয়া
- সৎ, নিরপেক্ষ ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন এবং ব্যর্থ নির্বাচন কমিশনারদের (Election Commissioners) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংসদীয় কমিটি গঠনের প্রস্তাবে অধিকাংশ দল একমত।
- মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে আইনি দিক বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে দলগুলো।
জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন সংস্কার
- জুলাই অভ্যুত্থান, ভোট জালিয়াতি ও নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাবে অধিকাংশ দল একমত।
- বর্তমান পাবলিক সার্ভিস কমিশন (Public Service Commission) ভেঙে তিনটি কমিশন গঠনের পক্ষে দলগুলোর সমর্থন রয়েছে।
প্রাদেশিক শাসন ও স্থানীয় সরকার প্রস্তাব
- দেশের চারটি পুরনো বিভাগকে প্রদেশে রূপান্তর, জেলা পরিষদ বিলুপ্তি ও পৌরসভা চেয়ারম্যান নির্বাচনে ওয়ার্ড সদস্যদের ভোট—এসব প্রস্তাবে দলগুলো একমত নয়।
চূড়ান্ত লক্ষ্য: ‘জাতীয় সনদ’
আলী রীয়াজ বলেন, কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে একটি জাতীয় সনদ প্রণয়ন। বাস্তবায়নের দায়িত্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (Interim Government) ও রাজনৈতিক দলগুলোর।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক
সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus)র সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় (State Guest House Jamuna) ঐকমত্য কমিশনের প্রতিনিধিদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, এমদাদুল হক, আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।