পানির রাজনীতি ও বাংলাদেশের বন্যা: প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ভূমিকা ও উত্তরণের পথ

বাংলাদেশের প্রতি বছরকার বর্ষাকালীন বন্যা এখন আর শুধুই প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়—এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে এক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। ভারত (India)–এর উজানে হঠাৎ করে পানি ছাড়া, তথ্য বিনিময়ের অভাব এবং নদী ব্যবস্থাপনায় একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রভাব সরাসরি পড়ছে বাংলাদেশের নদ-নদী ও কৃষিজমিতে। মে ২০২৫ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হওয়া আকস্মিক বন্যা এরই একটি নতুন দৃষ্টান্ত।

বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি: পূর্বাভাস ও ক্ষয়ক্ষতি

পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিডব্লিউডিবি) (BWDB)–এর তথ্য অনুযায়ী, সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বিপৎসীমার ৫০-৯০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিশেষ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, জামালপুরগাইবান্ধা অঞ্চল সবচেয়ে ঝুঁকিতে।

ফ্লাড ফোরকাস্টিং অ্যান্ড ওয়ার্নিং সেন্টার (এফএফডব্লিউসি) সতর্ক করেছে যে, অতিরিক্ত বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে পানি ছাড়ার কারণে জুনের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে উচ্চমাত্রার বন্যা দেখা দিতে পারে।

ভারতের ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক আইন

ভারতের গজলডোবা ব্যারাজ, ধলই বাঁধ, ডুম্বুর বাঁধ ইত্যাদি থেকে হঠাৎ পানি ছেড়ে দেওয়ায় বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যদিও ভারত দাবি করেছে, কিছু বাঁধের গেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেছে, তবু আগাম কোনো সতর্কতা না দেওয়ায় বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে।

১৯৯৭ সালের ইউএন কনভেনশন অন নন-নেভিগেশনাল ইউজেজ অফ ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্সেস–এর ধারা ৫, ৭ ও ১১ অনুযায়ী, উজান রাষ্ট্রের পানি ব্যবস্থাপনায় নিচু রাষ্ট্রের ক্ষতি না হওয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে এবং আগাম অবহিত করতে হবে।

বাংলাদেশের প্রভাব ও মানবিক সংকট

২০২৫ সালের মে মাসেই প্রায় ৪.৩ লাখ মানুষ পানিবন্দী। কৃষি ক্ষতি ভয়াবহ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল জানিয়েছে, বোরো ধানের প্রায় ৩০ শতাংশ এখনো মাঠে রয়ে গেছে, যা ডুবে গেলে পুরোপুরি ধ্বংস হবে।

২০২৪ সালে ভারতের আগাম বার্তা ছাড়া পানি ছেড়ে দেওয়ায় পূর্বাঞ্চলের ১২টি জেলায় ৫৮ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ক্ষতি দাঁড়িয়েছিল ১৪,৪২১ কোটি টাকায়। এবার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের সংকটে পড়েছেন লাখো মানুষ।

করণীয়: তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ

**তাৎক্ষণিক করণীয়
– সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবীদের সমন্বয়ে উদ্ধার তৎপরতা
– পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র, মেডিকেল ক্যাম্প ও খাবার বিতরণ
– কৃষি পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষণা: মানসম্পন্ন বীজ, ভাসমান বাগান, জলমগ্ন সহনশীল জাত, কৃষিঋণ
– ক্ষতিগ্রস্ত পশুসম্পদ ও মৎস্য খাতের জন্য পুনরুদ্ধার প্যাকেজ

দীর্ঘমেয়াদি ও কূটনৈতিক করণীয়:
– ভারতের সঙ্গে বাধ্যতামূলক রিভার ইনফরমেশন শেয়ারিং চুক্তি করা
যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) (JRC)–কে আরও কার্যকর করা
– আন্তর্জাতিক ফোরামে পানি ইস্যুতে কূটনৈতিক চাপ বাড়ানো—জাতিসংঘ, সার্ক, বিমসটেক
– প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা: আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম, ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট অবকাঠামো, নদী বাঁধ উন্নয়ন
জাতীয় কৃষি পুনর্বাসন টাস্কফোর্স গঠন ও বাস্তবায়ন

প্রস্তাবিত বাজেটে বন্যা মোকাবেলায় বরাদ্দ দাবি

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বন্যা প্রতিরোধ ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় কমপক্ষে ৫,০০০ কোটি টাকার আলাদা বরাদ্দ জরুরি।

উপসংহার: পানি কূটনীতি প্রয়োজন

এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজন একটি শক্তিশালী “পানি কূটনীতি”—যেখানে ‘শক্তি’ নয়, বরং ‘সমতা ও সহযোগিতা’ হবে দক্ষিণ এশিয়ার নদী ব্যবস্থাপনার ভিত্তি। বাংলাদেশের মানুষের জীবন, জীবিকা ও খাদ্যনিরাপত্তা রক্ষায় এই সংকট এখন আর অবহেলার নয়—এটি একটি বৈশ্বিক দায়।