বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের উত্থান এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠেছে বিকল্প গণমাধ্যম, আর তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন পিনাকী ভট্টাচার্য (Pinaki Bhattacharya), ইলিয়াস হোসেন (Elias Hossain), জুলকারনাইন সায়ের (Zulkarnain Saer), তাসনিম খলিল (Tasneem Khalil) প্রমুখ।
তথ্যের বিবর্তন ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের বিকাশ
এক সময় বই, জার্নাল ও সংবাদপত্র ছিল প্রধান তথ্যসূত্র। পরে টেলিভিশনের আবির্ভাব এবং ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় পরিবর্তন আসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউব হয়ে ওঠে তথ্য প্রচারের বড় প্ল্যাটফর্ম। মূলধারার গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতার মধ্যে এগুলো হয়ে ওঠে বিকল্প কণ্ঠস্বর।
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের উত্থান
বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রেক্ষাপটে অনেক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তারা সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, বিকল্প বিশ্লেষণ ও মতামত তুলে ধরেন। বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবের সময় তাদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
পিনাকী ভট্টাচার্য
১৯৬৭ সালে জন্ম নেওয়া পিনাকী ভট্টাচার্য একজন সাবেক চিকিৎসক, লেখক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট। ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের পর থেকেই তিনি রাষ্ট্রের রাডারে আসেন। বর্তমানে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন। ফেসবুক ও ইউটিউবে তার অনুসারীর সংখ্যা প্রায় অর্ধকোটি। সরকার ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা নিয়ে তার বিশ্লেষণ জনপ্রিয়তা পায়।
ইলিয়াস হোসেন
চুয়াডাঙ্গায় জন্ম নেওয়া সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা রয়েছে। তিনি বিভিন্ন অনলাইন কন্টেন্ট ও আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারবিরোধী বক্তব্য দিয়ে পরিচিত হন। সাম্প্রতিক সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান দিয়েও আলোচনায় আসেন।
জুলকারনাইন সায়ের খান সামি
যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক সামি আলোচিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ প্রতিবেদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেনা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তথ্য ফাঁস করে তিনি অনলাইনে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের বিষয়ে সমর্থনমূলক বক্তব্য দিয়েও তিনি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন।
তাসনিম খলিল
সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিলের প্রতিষ্ঠিত নেত্র নিউজ (Netra News) থেকে ‘আয়নাঘর’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে গুমের বিষয়ে আলোকপাত করেন। তিনি ১/১১ সরকারের সময় নির্যাতনের শিকার হন এবং পরবর্তীতে দেশত্যাগ করেন। আন্দোলনে তার বিশ্লেষণ জনমত গঠনে প্রভাব ফেলে।
অন্যান্য প্রভাবশালী অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
এছাড়া অনলাইন সক্রিয়তায় ভূমিকা রাখেন সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দিন, ড. কনক সারওয়ার, মোস্তফা ফিরোজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর নুরুজ্জামান কাফি প্রমুখ।
মতপার্থক্য ও বিতর্ক
৫ আগস্টের পর অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। বিশেষ করে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান (Waqar Uz Zaman)কে নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। পিনাকী ও ইলিয়াস যেখানে সমালোচনামুখর ছিলেন, সামি ছিলেন সমর্থনকারীর ভূমিকায়।
সাম্প্রতিক সময়ে অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ও আসিফ মাহমুদ সজীব নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারি এবং বিতর্কও বেশ আলোড়ন তোলে। মির্জা আব্বাস অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের দেশে ফিরে কাজ করার আহ্বান জানান।
উপসংহার
তথ্য প্রবাহ, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও জনমত গঠনে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা এখন একটি শক্তিশালী বলয়ে পরিণত হয়েছেন। মূলধারার গণমাধ্যমকে পাশ কাটিয়ে তারা হয়ে উঠেছেন বিকল্প গণমাধ্যম। ভবিষ্যতের রাজনৈতিক কাঠামোতে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।