দেশের ১৬টি গোপন বন্দিশালা চালানো হতো হাসপাতাল-ক্লিনিক ছদ্মনামে: গুম কমিশনের ভয়াবহ প্রতিবেদন

সারাদেশে চিকিৎসা কেন্দ্রের ছদ্মবেশে পরিচালিত ১৬টি গোপন বন্দিশালার খোঁজ পেয়েছে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন (Disappearance Investigation Commission)। এসব বন্দিশালা পরিচালিত হতো র‍্যাব (RAB), পুলিশ (Police), ডিজিএফআই (DGFI), ডিবি (DB), সিটিটিসি (CTTC) সহ ছয়টি নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে। বন্দিশালাগুলোর বেশিরভাগই রাজধানী ঢাকা (Dhaka) ও বগুড়া (Bogra) এলাকায় অবস্থিত।

‘হাসপাতাল’, ‘ক্লিনিক’, ‘গ্লাস হাউস’: বিভ্রান্তিকর কোডনাম

কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীর র‍্যাব-১ (RAB-1) সদর দপ্তরের ভেতরে ও পাশে অবস্থিত একটি ভবনে ‘হাসপাতাল’, ‘ক্লিনিক’, ‘গ্লাস হাউস’ নামে পরিচিত বন্দিশালা পরিচালিত হতো। ভুক্তভোগীরা জানান, এইসব জায়গায় দিনের পর দিন তাদের আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হতো।

কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন (Sajjad Hossain) বলেন, “রেশন রুমের মতো সাজানো জায়গা ছিল যেখানে সাধারণ মানুষ সন্দেহ করত না। সেখানে গোপন টর্চার চেম্বার পাওয়া গেছে।”

তিনি জানান, মূল ‘গ্লাস হাউস’ ছিল র‍্যাব হেডকোয়ার্টারের পাশের একটি ভবনে, যেটিকে আবার ‘ক্লিনিক’ বা ‘হাসপাতাল’ হিসেবে দেখানো হতো।

ছয়টি বাহিনী পরিচালনা করত এসব বন্দিশালা

কমিশনের তদন্ত অনুযায়ী, এই ১৬টি বন্দিশালা পরিচালনায় জড়িত ছিল ছয়টি বাহিনী ও সংস্থা—র‍্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি, সিটিটিসি, পুলিশ, এবং অন্যান্য গোয়েন্দা ইউনিট। কিছু বন্দিশালা ছিল নিজস্ব ভবনে, আবার কিছু স্থাপন করা হতো ভাড়া করা সেফ হাউসে।

বগুড়ার পুলিশ লাইন্স ছিল ‘নর্থ বেঙ্গলের হাব’। এটি ডিজিএফআই পরিচালিত হতো এবং সেখানে ভিন্ন জেলা থেকে ধরে আনা ব্যক্তিদের আটকে রাখা হতো।

শত শত ভুক্তভোগীর বর্ণনায় মিলে নির্যাতনের প্রমাণ

তদন্তে শুরুতে ধারণা ছিল, গুমের শিকার ব্যক্তিদের রাখা হতো কেবল জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (JIC) নামে পরিচিত একটি ডিজিএফআই নিয়ন্ত্রিত জায়গায়। তবে শত শত ভুক্তভোগীর সাক্ষ্যে জানা যায়, ঢাকায় আরও অন্তত চার-পাঁচটি গোপন বন্দিশালার অস্তিত্ব রয়েছে।

সরাসরি অভিযুক্তদের নাম, গ্রেফতারি পরোয়ানাও

কমিশনের রিপোর্টে কেবল অবস্থান নয়, অভিযুক্ত বাহিনী, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং কার নির্দেশে অপারেশন হয়েছে—তা-ও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেও তারা এখনও আইনের আওতায় আসেননি।

মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ

মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ (Human Rights Org Odhikar) এর পরিচালক নাসিরউদ্দিন এলান (Nasiruddin Elan) বলেন, “এত বড় একটি ঘটনার পর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সেফ এক্সিট দেওয়া মারাত্মক অপরাধ। তারা আত্মগোপনে চলে গেছেন।”

তদন্তে বাধা ও অসহযোগিতার অভিযোগ

কমিশনের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, তদন্তের প্রতিটি ধাপে তারা বাধা ও অসহযোগিতার সম্মুখীন হয়েছেন। অভিযুক্তদের গ্রেফতার না হলে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত সম্ভব নয় বলেও তারা মন্তব্য করেন।

এই গোপন বন্দিশালাগুলোর অস্তিত্ব গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নৈতিক অবক্ষয়কে তুলে ধরে। কমিশনের রিপোর্টে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো শুধু মানবাধিকার নয়, রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা সম্পর্কেও গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।