সংস্কার নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির ভিন্নমত: রাজনৈতিক ঐকমত্য অনিশ্চয়তায়

নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক সংস্কার ও সংবিধান সংশোধনের ইস্যুতে বিএনপি (BNP), জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami) এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (National Citizen Party – NCP)—এই তিন দলের মধ্যে মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব মতবিরোধ নির্বাচনপূর্ব সংস্কার এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভবিষ্যৎকে ঘিরে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

বৈঠকে আপাত দ্বন্দ্বের অবসান, তবে নতুন চ্যালেঞ্জ

লন্ডন বৈঠকের পর বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব কিছুটা প্রশমিত হলেও রাজনৈতিক সংস্কার, সংবিধান সংশোধন এবং সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে নতুন করে সংশয় তৈরি হয়েছে। এসব ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীএনসিপি-র সঙ্গে বিএনপি-রও মতানৈক্য দেখা দিয়েছে।

ঐকমত্য কমিশনের লক্ষ্য ও সীমাবদ্ধতা

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এর সহসভাপতি আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, মোট ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে সবগুলোতে একমত হওয়া সম্ভব নয়, তবে মৌলিক বিষয়গুলোতে ঐকমত্যই জাতীয় ঐকমত্যের প্রকৃত রূপ হবে। তার মতে, “একটা জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ক্ষমতা যেন এককেন্দ্রিক না হয়, সেটাই লক্ষ্য।”

প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও একাধিক পদে থাকা নিয়ে ভিন্নমত

ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি যেন দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন—এমন মত প্রায় সব দলের সমর্থন পেলেও বিএনপি ব্যতিক্রম। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, প্রয়োজনে বিরতির মাধ্যমে তৃতীয়বারও প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত হতে পারে, যদি জনগণ চান।

একইভাবে, একই ব্যক্তির দলীয় প্রধান ও সরকার প্রধানের পদে একসঙ্গে থাকা নিয়ে বিএনপি দ্বিমত পোষণ করে। আমীর খসরু বলেন, একজন ব্যক্তি দলের রাজনীতিতেই উঠে এসেছেন, সুতরাং দলের নেতৃত্বে থাকাটা যুক্তিসঙ্গত।

কর্তৃত্ববাদী শাসনের আশঙ্কা

এ ধরনের প্রস্তাবের বিপরীতে জামায়াতে ইসলামী-র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এতে করে দেশের রাজনীতি এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যেতে পারে এবং কর্তৃত্ববাদ ফিরে আসতে পারে।

সংস্কার বাস্তবায়ন: নির্বাচন আগে না পরে?

জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি চায় নির্বাচনের আগেই সংস্কার কার্যকর হোক। হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, সংস্কার বাস্তবায়ন না হলে তা পরে ঝুলে যেতে পারে। এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসাইন বলেন, প্রয়োজন হলে অধ্যাদেশ জারি করেও সংস্কার করতে হবে।

নতুন সংবিধান না সংশোধন?

এনসিপি নতুন সংবিধান চাইলেও বিএনপি ও জামায়াত সংশোধনের পক্ষে। আখতার হোসাইন মনে করেন, শুধু সংশোধন করলে তা ভবিষ্যতে বাতিল হয়ে যেতে পারে, যেমন অতীতে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বেশ কিছু বিধান বাতিল করেছে।

ঐকমত্য না হলে পথ কী?

বিএনপির মতে, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো নিয়েই জুলাই সনদ তৈরি হবে। বিরোধপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে দলগুলো জনগণের ম্যান্ডেট চাইতে পারে নির্বাচনে। তবে এতে মৌলিক বিষয়গুলো বাদ পড়ার আশঙ্কা করছেন এনসিপিসহ অনেকে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, মৌলিক বিষয়ে সংস্কার না হলে তারা জুলাই সনদের সমর্থন দেবে না।

সমাধান কি গণভোট?

জামায়াতে ইসলামী প্রস্তাব দিয়েছে, মতপার্থক্য থাকলে গণভোটের মাধ্যমে সেগুলো নির্ধারণ করা হোক। হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জনগণের রায়ের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে সেটি বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।

আশাবাদী ঐকমত্য কমিশন

সব মতপার্থক্যের মধ্যেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, কিছু ছাড় দিলে জাতীয় ঐক্য গঠন সম্ভব।

তবে সরকারের নিরপেক্ষতা এবং সংস্কারের বাস্তবায়ন ঘিরে সংশয় এখনো থেকেই যাচ্ছে, যা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ঐকমত্য অর্জনের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।