বিদ্যুৎ খাতের নামে গড়ে তোলা কুইক রেন্টাল (Quick Rental) প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে দীর্ঘ এক যুগ ধরে হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ([Nasrul Hamid Bipu]) ও তার ঘনিষ্ঠ মহলের বিরুদ্ধে।
ক্যাপাসিটি চার্জ: লুটপাটের নিয়মিত উৎস
‘কুইক রেন্টাল’ চালু হয় বিগত ‘ফ্যাসিস্ট সরকারে’র সময়ে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে চুক্তিভিত্তিক মাসিক অর্থ প্রদান—যথা ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’। বিদ্যুৎ উৎপাদন হোক বা না হোক, বিদেশি মুদ্রায় এই অর্থ পরিশোধ বাধ্যতামূলক ছিল।
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু নিজেই বলতেন, “কুইক রেন্টাল হলো আমার সোনার ডিম পাড়া হাঁস।” তার সময়ে শতাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হয় কোনো দরপত্র ছাড়াই। যদিও সরকারি তথ্যে উৎপাদন ক্ষমতা দেখানো হয়েছে ২৫ হাজার মেগাওয়াট, লোডশেডিংয়ের সমাধান আসেনি।
বিদ্যুৎ খাতে ৩ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকার ব্যয়
আওয়ামী লীগ ([Awami League]) সরকারের তিন মেয়াদে বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার, যা বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ। এই টাকা চলে গেছে মূলত দলীয় নেতা ও ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে।
কুইক রেন্টালের চাবি ও কমিশন বাণিজ্য
২০১৪ সালের পর এই খাতের নিয়ন্ত্রণ আসে বিপুর হাতে। লাইসেন্স পেতে হতো কমিশন দিতে। কাগজে-কলমে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমতি নিয়ে কোটি কোটি টাকায় তা বিক্রি করা হয়েছে একাধিকবার। যেমন, প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ([Jahangir Kabir Nanak]) বিক্রি করেন তার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাইসেন্স আসলাম উল হকের ([Aslamul Haque]) কাছে, যিনি পরে তা বিক্রি করেন সিকদার গ্রুপ ([Sikder Group])-এর কাছে।
অন্যান্য লাইসেন্সপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন:
– ইন্তেখাবুল হামিদ অপু ([Intekhabul Hamid Apu])
– নাহিম রাজ্জাক ([Nahim Razzaq])
– জালাল ইউনুস ([Jalal Yunus])
– হাছান মাহমুদ ([Hasan Mahmud])
– সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ([Saifuzzaman Chowdhury Javed])
– শাহরিয়ার আলম ([Shahriar Alam])
– তানভীর হাসান ছোট মনির ([Tanvir Hasan Chhoto Monir])
– ফরিদুর রহমান ([Faridur Rahman])
– হাবিবুর রহমান এমপি ([Habibur Rahman])
– এনামুল হক এমপি ([Enamul Haque])
বড় গ্রাহক ও পৃষ্ঠপোষকরা
১৪ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো:
- সামিট গ্রুপ ([Summit Group]) – ১০,৬২৩ কোটি টাকা (পৃষ্ঠপোষক: সজীব ওয়াজেদ জয় ([Sajeeb Wazed Joy]))
- এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল ([Agrico International]) – ৭,৯৩২ কোটি টাকা (পৃষ্ঠপোষক: রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ([Ridwan Mujib Bobby]), এজেন্ট: এস আলম ([S Alam]))
- এরদা পাওয়ার ([ERDA Power Holdings]) – ৭,৫২৩ কোটি টাকা (এজেন্ট: আবুল কালাম আজাদ ([Abul Kalam Azad]))
- ইউনাইটেড গ্রুপ ([United Group]) – ৬,৫৭৫ কোটি টাকা
- রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ([RPCL]) – ৫,১১৭ কোটি টাকা
- বাংলা ক্যাট গ্রুপ ([Bangla CAT Group]) – ৫,০৬৭ কোটি টাকা
- পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ([Payra Power Plant]) – ৪,৫৫০ কোটি টাকা
- খুলনা পাওয়ার কোম্পানি ([Khulna Power Company – KPCL]) – ৪,০৫৪ কোটি টাকা
দুর্নীতির শ্বেতপত্র ও অবৈধ নিয়োগ
সরকার কর্তৃক গঠিত দুর্নীতির শ্বেতপত্র কমিটি তাদের প্রতিবেদনে জানায়, দরপত্রে প্রতিযোগিতা না দেখিয়ে একই গোষ্ঠীর কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হয়েছে। উপরের কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠদের সাবকন্ট্রাক্ট দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার ডিপিডিসি ([DPDC]), পিডিবি ([PDB]), ডেসকো ([DESCO]), আরইবি ([REB]), ও নেসকো ([NESCO])-এর মিটার প্রকল্পে সিন্ডিকেট করে কাজ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এতে জড়িত ছিলেন ওবায়দুল কাদের ([Obaidul Quader])-এর ভাতিজা ও কেরানীগঞ্জ ([Keraniganj])-এর শাহীন চেয়ারম্যান।
বিদেশে সফর ও অর্থ পাচার
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় নসরুল হামিদ বিপু বিদেশ সফর করেছেন ৩৮ বার, প্রতিবারই কমপক্ষে দুই দিন করে দুবাই ([Dubai]) অবস্থান করেছেন। ধারণা করা হয়, লুটপাটের অর্থ সেখানেই হস্তান্তর হতো।