বিবিসির প্রতিবেদনে প্রকাশ আয়নাঘরের ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র

বিবিসি সম্প্রতি এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আয়নাঘর নামে পরিচিত বাংলাদেশের গোপন বন্দিশালার ভয়াবহ চিত্র উন্মোচন করেছে। প্রতিবেদনে প্রকাশ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তিদের গোপনে আটক, নির্যাতন ও গুম করা হতো এই বন্দিশালায়। সাবেক বন্দিরা জানিয়েছেন, এই নির্যাতন ছিল মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ।

আয়নাঘর: বিমানবন্দরের পাশেই গোপন কারাগার

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে খুব কাছেই আয়নাঘরের অবস্থান নিশ্চিত করেছে তদন্তকারীরা। ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম জানান, তাকে আট বছর ধরে এই বন্দিশালার একটি জানালাবিহীন সেলে আটক রাখা হয়। মেঝেতে নীল টাইলস, টয়লেটসহ ছোট্ট সেই কক্ষে দিনের আলো প্রবেশ করত না।

নির্যাতনের বর্ণনায় শিউরে উঠার মতো চিত্র

বিন কাসেম বলেন, “এটা ছিল জীবন্ত কবর। বাতাসের জন্য দরজার ফাঁকে মুখ রাখতাম।” তাকে ছাড়া আরও পাঁচজন সাবেক বন্দি বলেছেন, কংক্রিটের সেলে হাত-পা বেঁধে, চোখ ঢেকে নির্যাতন চালানো হতো। যাদের অনেককেই চিরতরে গুম করে ফেলা হয়েছে।

আতিক, রহমতুল্লাহ ও ইকবালের করুণ অভিজ্ঞতা

অপর ভুক্তভোগী আতিকুর রহমান রাসেল জানান, র‍্যাব পরিচয়ে তাকে অপহরণ করে অন্ধকার কক্ষে আটক রাখা হয়। সেখানে তাকে মারধর করা হয়, নাক ভাঙা ও শরীরে স্থায়ী ক্ষতি হয়।

২৩ বছরের রহমতুল্লাহ বলেন, “তারা আমার দেড় বছর কেড়ে নিয়েছে।” তাকে এমন কক্ষে রাখা হয়, যেখানে মল-মূত্র ত্যাগের জন্য খোলা ড্রেন ছাড়া কিছু ছিল না।

৭১ বছরের ইকবাল চৌধুরী বলেন, তাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হয়। এখন তার আঙুল বিকল, পায়ের জোর কমে গেছে। তিনিও গুমের শিকার ছিলেন।

তদন্তকারীদের অনুসন্ধান ও সরকারি প্রতিক্রিয়া

তদন্তকারীরা জানান, এই আয়নাঘরগুলো পরিচালিত হতো র‍্যাব-এর কিছু সদস্যদের মাধ্যমে, যারা হাসিনার সরাসরি নির্দেশে কাজ করতেন। গুম-খুনের অভিযোগে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১২২টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এর প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, “হাসিনার অনুমোদনে এসব ঘটনা ঘটেছে।” তিনি জানান, সারা দেশে ৫০০-৭০০ আয়নাঘরের অস্তিত্ব রয়েছে।

সরকার ও সেনাবাহিনীর অস্বীকৃতি

আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “সরকারের কোনো রাজনৈতিক লাভ হয়নি।” বাংলাদেশ সেনাবাহিনী-র মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল্লাহ ইবনে জায়িদ জানান, “এমন কোনো বন্দিশালার সঙ্গে সেনাবাহিনী জড়িত নয়।”

বিচার হবে: আশা প্রসিকিউটরের

প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “এতদিনেও কাউকে বিচারের আওতায় আনা না গেলেও, একদিন বিচার হবে— এটাই আমাদের বিশ্বাস।”