‘উন্নয়নের জোয়ার’ থেকে ‘ইউনূস ম্যাজিক’—শব্দের খেলায় দেশের অর্থনীতির বাস্তবতা ব্যাখ্যা করলেন ড. বিরূপাক্ষ পাল

উন্নয়নের জোয়ার’ বা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’—এইসব রাজনৈতিক শব্দগুচ্ছ কীভাবে দেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে, তার গভীর বিশ্লেষণ দিয়েছেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ড (State University of New York at Cortland)-এর অর্থনীতির অধ্যাপক ড. বিরূপাক্ষ পাল (Dr. Birupaksha Paul)।

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণধর্মী কলামে তিনি উল্লেখ করেন, আওয়ামী আমলে যেমন ‘উন্নয়নের জোয়ার’ বা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ শব্দগুলোর বিস্তার ছিল, তেমনি বর্তমানে ‘ইউনূস ম্যাজিক’, ‘নতুন বন্দোবস্ত’, ‘সংস্কার’ ইত্যাদি শব্দ দিয়ে অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

তিনি স্মরণ করেন, ১৯৯৩ সালে বিশ্বব্যাংক (World Bank) ‘দ্য ইস্ট এশিয়ান মিরাকল’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানের উন্নয়নকে বিস্ময় বলে আখ্যা দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালে তিনি জাতিসংঘ (United Nations)-এর নীতিনির্ধারক ড. সেলিম জাহান (Dr. Selim Jahan)-এর কাছে ‘মিরাকল’ শব্দের ব্যাখ্যা জানতে চান। জবাবে ড. জাহান বলেন, এগুলো শ্রম এবং সুশাসনের ফল, বিস্ময়ের কিছু নয়।

কলামে ড. পাল প্রশ্ন তোলেন, আজকের বাংলাদেশে যেসব গণমাধ্যম অর্থনৈতিক উন্নয়নের ম্যাজিকের কথা বলছে, তারা কি কোনো স্বর্ণখনির সন্ধান পেয়েছে? তার ভাষায়, এসব খবর হচ্ছে ‘তুষ্টিসাধক সংবাদ’, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাস্তবতা আড়াল করে একটি সুখবর নির্ভর চিত্র উপস্থাপন।

তিনি বলেন, দেশে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ২০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ২০২৪ সালের জুনে যেখানে ছিল ১৩ শতাংশ, ডিসেম্বরে তা দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশের বেশি। ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহের হার কমেছে, বিদেশি বিনিয়োগ নেমেছে পাঁচ বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। গত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ৮২৪ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় কম। মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় বেড়েছে, ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ঋণাত্মক ৭ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। পুঁজিপণ্যের আমদানি কমেছে ২৫ শতাংশ, যা উৎপাদন ও দক্ষতার ওপর প্রভাব ফেলছে।

তিনি আরও বলেন, “জাতীয় দারিদ্র্য ফের বাড়ছে এবং বিশ্বব্যাংকের মতে নতুন করে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ অতিদরিদ্র হবে। জাতীয় দারিদ্র্যের হার দাঁড়াতে পারে ২৩ শতাংশে।” রিজার্ভ বাড়ার খবরে ‘ম্যাজিক’ উদ্ভবের দাবিকে তিনি বাস্তবতাবিরোধী বলেন। তার মতে, রিজার্ভ হচ্ছে কেবল একটি অর্থনৈতিক নির্দেশক, জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের মাপকাঠি নয়।

ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমগুলোর পেশাদারিত্বহীন সংবাদ প্রচার নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। বলছেন, এসব তথাকথিত “ম্যাজিক” দিয়ে দারিদ্র্য, বেকারত্ব বা ক্ষীয়মান অর্থনীতির বাস্তবতা ঢেকে রাখা সম্ভব নয়। অর্থনীতির জাদু নয়, চাই পরিশ্রম, সুশাসন ও সত্যিকারের সংস্কার।