রেলে লুটপাট-নির্যাতনের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন ফজলে করিম ও তার ছেলে

গত ১৫ বছরে রেল খাতে ভয়াবহ দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে সাবেক সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী (Fazle Karim Chowdhury) এবং তার ছেলে ফারাজ করিম চৌধুরী (Faraz Karim Chowdhury)-র বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশন (ACC)-এর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, রেলের বিভিন্ন প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে এবং এই তৎপরতার নেতৃত্বে ছিলেন ফজলে করিম ও তার ছেলে।

পরিকল্পনাহীন প্রকল্পে ১৫ বছরে ব্যয় প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা

শেখ হাসিনার (Sheikh Hasina) নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রায় ৯৭টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, যার ব্যয় ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে কোনো সমীক্ষা ছাড়াই এবং প্রকল্পের ব্যয় ১০-১৫ গুণ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। ফজলে করিমের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে একটি দুর্নীতিপরায়ণ সিন্ডিকেট, যারা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বাজেট ৩৬০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে যায়।

সন্ত্রাসী চক্রের নেতৃত্ব ও টর্চার সেলের ভয়াবহতা

তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম (Chattogram)-এ ফজলে করিম ও ফারাজ করিম একটি টর্চার সেল তৈরি করেন, যেখানে রেল কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের জিম্মি করে নির্যাতন চালানো হতো। সেখানে বিভিন্ন প্রকল্প ও ক্রয়সংক্রান্ত বৈঠক হতো, এবং যারা অমত করত তাদের ওপর চালানো হতো শারীরিক নির্যাতন।

বাবর ও তার সহযোগীদের সন্ত্রাস

এই সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিলেন যুবলীগ (Jubo League) নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের আরও শতাধিক নেতা। তারা রেল টেন্ডার, চাঁদাবাজি এবং প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফজলে করিমের ছত্রছায়ায় বাবরের বিরুদ্ধে থাকা ৯টি মামলার একটিও কার্যকর হয়নি।

রেলের কর্মকর্তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা

একাধিক কর্মকর্তা জানান, ফজলে করিমের নির্দেশ পালন না করলে রাতের বেলা বাসায় ঢুকে অস্ত্রের মুখে গালাগাল ও হামলার শিকার হতেন তারা। সিআরবি (CRB) এলাকায় থাকা ফজলে করিমের ঘনিষ্ঠ সন্ত্রাসীরা নিয়মিত মহড়া দিতেন। এমনকি ঢাকা ও রাজশাহী থেকেও কর্মকর্তারা তার সঙ্গে দেখা করতে বাধ্য হতেন।

নামে-বেনামে ঠিকাদারি ব্যবসা ও দুর্নীতির বিস্তার

ফজলে করিম ও তার শ্যালক এম এহসান ‘নেক্সট জেনারেশন গ্রাফিক্স’, ‘ফেব ডিজেল সেলস অ্যান্ড সার্ভিস’, ‘ম্যাক্সিমাম সাপোর্ট লিমিটেড’সহ একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রেলে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করা হতো।

কর্মকর্তাদের অভিযোগ ও সতর্কতা

রেলওয়ে শ্রমিক দল (Railway Workers’ Party)-এর সাধারণ সম্পাদক এমআর মঞ্জুর বলেন, “গত ১৫ বছরে রেল খাতে সিস্টেমেটিক লুটপাট ও সন্ত্রাস চালিয়েছে আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা। তারা রেলকে জিম্মি করে রেখেছিল।” তিনি জানান, রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখনো সতর্কাবস্থায় রয়েছে এবং মন্ত্রণালয়ে তালিকা জমা দেওয়া হয়েছে।

তদন্ত ও সম্ভাব্য ব্যবস্থা

রেল উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, “দুদকে বিপুলসংখ্যক অভিযোগ জমা পড়েছে। আমরাও তথ্য-উপাত্ত দিচ্ছি। অনুসন্ধানে প্রতিটি অনিয়ম ধরা পড়ছে এবং তদন্ত শেষে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”