সাঈদী (Delwar Hossain Sayedee)–এর বিপক্ষে সাক্ষ্য না দেওয়ায় ২০১২ সালে নিখোঁজ হন সুখরঞ্জন বালি (Sukhuranjan Bali)। দেশে ফিরে তিনি জানান, কীভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় তাকে অপহরণ করে ভারতের কারাগারে পাঠানো হয় এবং সেখানে তিনি টানা ৬ বছর আটক ছিলেন।
অপহরণের বিবরণ
২০১২ সালের ৫ নভেম্বর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ঢাকা (Dhaka) কোর্ট চত্বরে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা তাকে গাড়ি থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে একটি অচেনা স্থানে নিয়ে যায়। তাকে চোখ বেঁধে অন্ধকার একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়, যেখানে কোনো জানালা ছিল না। বালি বলেন, “সেখানে আমাকে মাঝে মাঝে খাবার দেওয়া হতো, পাহারাদাররা নীল পোশাক পরা ছিল।”
স্বীকারোক্তির জন্য নির্যাতন
কয়েকদিন পর তাকে অন্য একটি রুমে নেওয়া হয় যেখানে তাকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (Delwar Hossain Sayedee)–এর বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তি দিতে চাপ দেওয়া হয়। তিনি অস্বীকার করলে তাকে বৈদ্যুতিক শকসহ শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। বলা হয়, “যদি সাক্ষ্য না দাও, তাহলে ফল ভালো হবে না।” তিনি জানান, তাকে টাকা দিয়ে প্রলুব্ধ করার চেষ্টাও করা হয়।
ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া ও বিএসএফের নির্যাতন
কয়েকদিন পর এক সকালে তাকে গাড়িতে করে তুলে সীমান্তের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি দেখতে পান বিএসএফ সদস্যরা অবস্থান করছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বালি বলেন, “আমি অনুনয় করেছিলাম যেন বিএসএফের হাতে তুলে না দেওয়া হয়, প্রয়োজনে আমাকে মেরে ফেলুক।” কিন্তু তাকে জোর করে বিএসএফ (BSF)–এর কাছে হস্তান্তর করা হয়, যেখানে তাকে প্রচণ্ড মারধর করা হয় এবং হাত পেছন দিয়ে মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়।
তিনি জানান, বিএসএফ সদস্যরা কোনো প্রশ্ন না করেই মারধর করে এবং পরে তাকে পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal)–এর স্বরূপনগর থানা (Swarupnagar Police Station) এলাকার বৈকারী বাজার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এরপর তাকে বশিরহাট (Basirhat) ও পরে দমদম জেল (Dumdum Jail)–এ স্থানান্তর করা হয়।
আত্মীয়ের মাধ্যমে খবর ও মুক্তি
দমদম জেলে থাকা অবস্থায় তার ভাগনে এক বন্দি হিসেবে তাকে চিনতে পারেন এবং পরবর্তীতে তার পরিবারের কাছে খবর পৌঁছে দেন। পরে পরিবার মানবাধিকার সংস্থা (Human Rights Organization) ও ভারতের প্রশাসনের সহায়তায় সুপ্রিম কোর্টের আদেশে ২০১৮ সালের প্রথম দিকে সুখরঞ্জন বালি মুক্তি পান এবং দেশে ফেরত আসেন।
সাক্ষ্য না দেওয়ার কারণ
বালি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভাইকে যারা হত্যা করেছিল তাদের তিনি চিনতেন এবং সাঈদীর কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। তিনি বলেন, “সাঈদী হুজুরকে আমি তখন চিনতামও না। তিনি পরে এমপি নির্বাচিত হন এবং আমাদের এলাকায় একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমি জানি, হুজুর নিরপরাধ। শত নির্যাতনের পরেও আমি সাক্ষ্য দেইনি। আমাকে ক্ষুদিরামের মতো ফাঁসি দিলেও আমি প্রস্তুত ছিলাম।”
দেশে ফিরে নিরাপত্তাহীনতা
সুখরঞ্জন জানান, দেশে ফিরে পিরোজপুর (Pirojpur)–এর নিজ এলাকা ইন্দুরকানি (Indurkani) যেতে পারেননি নিরাপত্তা হুমকির কারণে। তিনি বলেন, “বাগেরহাটের আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় আমি লুকিয়ে ছিলাম।”
সাঈদীর মৃত্যুর পর জানাজায় অংশগ্রহণ করার পর তিনি আবার আত্মগোপনে চলে যান। তার ভাষায়, “আমাকে গুম করে, নির্যাতন করে, বিজিবির সহায়তায় বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আমি নিরপরাধ ছিলাম, শুধুমাত্র সাক্ষ্য না দেওয়ার কারণে এই শাস্তি পেতে হয়েছে।”